“ কী ? বিয়ে শাদী করছো ? না এখনো আজান দিয়েই চলতেছো?”
এই কথা স্কুল জীবন থেকেই শুনে আসছি, সিনিয়র ভাইদের মুখে এমন কথা শুনে কিশোর বয়সে ভাবতাম, বিয়ের সাথে আজানের কি সম্পর্ক ? আজান দিয়ে চললে কি বিয়ে করতে হয় না ? কলেজে পড়ার সময় আমরা বন্ধুরাও বিষয়টা বুঝে একে অপরকে এই কথা বলতাম । কিন্তু এর শানে নুযুল জানতাম না । ইউরোপে থাকতে একবার সুইজারল্যান্ড গিয়েছিলাম বেড়াতে । অস্টৃয়া-সুইজারল্যান্ড প্রতিবেশি দেশ । ভিয়েনা থেকে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ ট্রেনে যেতে সময় লাগে ৭ ঘন্টা । আমি, কালাম, বাবু, নিউটন, পিটার আর মাইকেল । কালাম ফেনির, আমি কুমিল্লার, বাবু ঢাকার গোরানের, নিউটন টাঙ্গাইলের, পিটার আর মাইকেল অস্টৃয়ান । আমাদের প্রধান কাজই ছিলো ঘুরাঘুরি করা । বাড়ি ভাড়া আর নিজের খরচের জন্য ৮ ঘন্টা চাকরি করা । ইউরোপ আমেরিকায় কাজের নির্ধারিত সময় দৈনিক আট ঘন্টা । সপ্তাহে ৪০ ঘন্টা । দুইদিন ছুটি । ছুটি না নিয়েও দুইদিন প্রতিবেশি যে কোন দেশে বেড়াতে যাওয়া যায় । আমরা ১ সপ্তাহ ছুটি নিয়েই গিয়েছিলাম । যুবক বয়সের ‘পোংটামি’ আর কি !
সুইজারল্যান্ড গিয়ে আমরা কি কি করবো জুরিখ অভিমুখী দ্রুতগামি চলন্ত ট্রেনে বসে সবাই আলোচনা করে তার একটা রুটিন করছিলাম । নিউটন সাত নাম্বারে লিখলো-নাইট ক্লাব ।
বাবু বিয়ার খেতে খেতে বললো, নিউটন আর কতোদিন আজান দিয়া চলবা ? বিয়ে করে বউ নিয়ে আসো । অস্টৃয়াতো ফ্যামিলি ভিসার ব্যাপারে বেশ নমনীয় । আমার মনে হলো, পাইছি । আজানের সঙ্গে বিয়ে । বাবুকে বললাম, বাবু, আমি জানি যুবকদের কাছে এই ডায়লগটা বেশ জনপ্রিয় । কোত্থেকে এই ডায়লগের উৎপত্তি তা জানি না । এর শানে নুযুল কী ? বাবু তাচ্ছিল্য করে বললো, এতো কিছু জানো আর এটা জানোনা ? বাবু এর শানে নুযুল বললো । আমি জেনে নিলাম ।
যখন ফ্লোরিডায় থাকতাম তখন একদিন মিজান ভাই শেল গ্যাস স্টেশনে এসে দুষ্টুমি করে আমাকে বললেন, তুমি বিয়ে করো না কেন ? আজান দিয়ে আর কতোদিন চলবা ? আবার আজান ! এশিয়ায় আজান, ইউরোপে আজান, আমেরিকাও আজান ! মিজান ভাই ফ্লোরিডায় ধনী বাংলাদেশি আমেরিকানদের একজন । ওখানে তখন সোহেল, বাবুল ভাই, বাদল, এঞ্জেলা, মিনারভা ছিলো । মিজান ভাইয়ের বাসা কুমিল্লার ঝাউতলা । গ্রামীনফোন কাস্টমার কেয়ার সার্ভিসের সঙ্গে লাগোয়া তিন তলা বিল্ডিংটা মিজান ভাইয়ের ।
আমি মিজান ভাইকে বললাম, আজান দিয়ে চলার শানে নুযুলটা কি আপনি জানেন ? মিজান ভাই বললেন, শানে নুযুল আমি জানি না । তুমি লেখালেখি করো তুমিই বলো । আমি তখন নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ঠিকানা আর ঢাকার সাপ্তাহিক যায়যায়দিনে লিখতাম । সুইজারল্যান্ড যাওয়ার পথে ট্রেনে বাবুর কাছে শোনা শানে নুযুলটা বললাম ।...
গ্রামের এক মসজিদের মুয়াজ্জিন প্রতিদিন আজান দেন । আর ফরজ নামাজের আগে আকামত দেন । মুয়াজ্জিনের প্রধান কাজই এই দুটো । মসজিদের পাশেই ছিলো ইমাম সাহেবের বাসা । ভোরে ফজরের আজান দেয়ার পর ইমাম সাহেব ঘুম থেকে উঠে আস্তে ধীরে মসজিদ এবং বাড়ির মাঝামাঝি পুকুরে অজু করে মসজিদে আসেন । ১০/১৫ মিনিট নিজে এবাদত করেন । মুসুল্লিরা এলে জামাত শুরু করেন । তো আজান দেয়ার পর মুয়াজ্জিন সাহেব মসজিদের সামনের খোলা জায়গায় এই সময়ে পায়চারী করেন । জামাত শুরুর আগে তার আর কোনো কাজ নেই । ওদিকে ইমাম সাহেবের স্ত্রীও উঠে উঠানে হাঁটাহাঁটি করেন । এভাবে দুজনের দৃষ্টি বিনিময় হতো । ধীরে ধীরে তা ভালোলাগায় গড়ায় । তো মুয়াজ্জিন সাহেব ভাবলেন, দু জনের দেখার সময়টা খুব কম । তাই পরদিন তিনি ১৫ মিনিট আগে আজান দিয়ে ফেলেন । আজান শুনে ইমাম সাহেব যথারীতি মসজিদে আসেন । আর ওই সুযোগে মুয়াজ্জিন সাহেব তার স্ত্রীর সঙ্গে গল্প টল্প করেন । তাদের ভালোবাসা যখন তুঙ্গে তখন একদিন মুয়াজ্জিন সাহেব ১ ঘন্টা আগে আজান দিয়ে ফেলেন । ইমাম সাহেব আজান শুনে মসজিদে আসেন আর এই সুযোগে মুয়াজ্জিন সাহেব ইমাম সাহেবের বাসায় গিয়ে তার স্ত্রীর সঙ্গে একান্তে সময় কাটানো শুরু করেন । ইমাম সাহেব মসজিদে এসে অনেকক্ষণ এবাদত বন্দেগি করে ঘড়িতে দেখেন আরো ৪০ মিনিট বাকি জামাত শুরু হবার । তিনি ভাবলেন, মুয়াজ্জিন সাহেব হয়তো ভুল করে আজ আজান আগে দিয়ে ফেলেছেন । সময় আছে দেখে ইমাম সাহেব ভাবলেন, বাসা যখন কাছে এই সময়ে এক কাপ চা খেয়ে আসা যায় । ইমাম সাহেব বাসায় এসে দেখেন তার স্ত্রী আর মুয়াজ্জিন এক বিছানায় । শেষ পর্যন্ত গ্রাম্য সালিশ বসলো । ইমাম সাহেবের স্ত্রী বলে মান সম্মানের দিকে চেয়ে গ্রামবাসী বেশি বাড়াবাড়ি না করে ওই মুয়াজ্জিনকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করলো । আর ইমাম সাহেব তাকে বললেন ,"তোরে যদি আর কোন দিন এই এলাকায় দেখি তবে জানে মাইরালামু। তুই মুয়াজ্জিন হইয়া কিভাবে ইমাম সাহেবের বউয়ের দিকে নজর দিলি ? তুই এক ঘন্টা আগে আজান দিয়া আমারে মসজিদে আইন্যা এই কামডা করলি !”
এখন এই মুয়াজ্জিন বেচারা কি কাজ করবেন ? তিনি মাদ্রাসায় পড়ালেখা করে মুয়াজ্জিন হয়েছেন । এটাই তার পেশা । তিনি ৩/৪ মাইল দূরে আরেক মসজিদে গিয়ে আবার মুয়াজ্জিনের চাকরি নেন । কয়েক বছর পর ওই এলাকায় এক বিরাট ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা হয় । এতে বিভিন্ন মসজিদের ইমামদেরও আমন্ত্রন জানানো হয় । তো ওই মসজিদের ইমাম সাহেবও আমন্ত্রিত হয়ে ওয়াজ মাহফিলে যোগ দেন । আর তখনি ওই মুয়াজ্জিনের সঙ্গে তার দেখা হয় । ইমাম সাহেব তখন মুয়াজ্জিনকে দেখে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে জিজ্ঞেস করেছিলেন , কী মিয়া ? বিয়ে শাদী করছো ? না আজান দিয়েই এখনো চলতেছো ? এটাই হলো ওই কথার শানে নুযুল । শোনে মিজাই ভাই বলেছিলেন, ‘তুই (আমি) একটা পোংটা । এসব পাস কই ?’ ( 'পোংটা' কুমিল্লার স্থানীয় শব্দ যার অর্থ ফানি ক্যারেক্টার ।)
বিঃদ্রঃ লেখাটিকে কেউ ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত বলে বিবেচনা করবেন না ।
·
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন