(১৯৯৮ সালের মে মাসে যায়যায়দিনের‘রান্না’নিয়ে বিশেষ সংখ্যায় এই লেখটি
প্রকাশিত হয়েছিলো । নিউ ইয়র্ক থেকে লিখেছিলাম । সেই ১৮ বছর আগে । অনেক
লেখাই হারিয়ে গেছে এলোমেলো জীবনে । হঠাৎ অনেক আগের লেখাটি পেলাম ।
হাজতবাস
করিম চৌধুরী
আমরা যারা ব্যাচেলর এবং বিদেশে থাকি এবং যারা বিবাহিত অথচ স্ত্রী দেশে থাকে রান্না তাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ । এই মহা বিরক্তিকর কাজে ফাঁকি দেয়ার কোনো সুযোগ নেই । চেষ্টা করে দেখেছি । লাভ হয়নি । ম্যাকডোনাল্ডস, হটডগ, বার্গার কিং, পিৎসা, স্টেক, কেএফসি কাহাতক সহ্য হয় । তবে রান্নার কারণে ঘন্টা খানেক হাজতবাস আমার কাছে ঐতিহাসিক ঘটনার মতোই । ফ্র্যাংকলি বললে ঘটনাটি এ রকম ।
তখন ইউরোপে থাকি । চার বছর আগের কথা । ( মানে ১৯৯৪ সালে । এখন থেকে ২৪ বছর আগের কথা) দেশ থেকে দু’জন বন্ধু পোল্যান্ড হয়ে জার্মানী এসেছে । রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে সরকারি বাড়িতে ফৃ থাকা খাওয়া ও চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত সাময়িকভাবে হয়েছে । ফোনে আমার সঙ্গে যোগাযোগ হলো । বললো, দোস্ত পারলে একবার আয় । আমার ভাগ্য কিছুটা ভালো ছিল । জার্মানীর প্রতিবেশী দেশ অস্টৃয়াতে তখন আমার ওয়ার্ক অথরাইজেশনসহ পারমানেন্ট রেসিডেন্ট পারমিট আছে । ভালো বেতনের ভালো একটি চাকরিও আছে । দিনে আট ঘন্টা ডিউটি । সপ্তাহে দু’দিন ছুটি । যে কোনো অ্যামবাসিতে ভিসা চাইলে কর্তৃপক্ষ কৃতজ্ঞ হয়ে যান । ছুটি না নিয়েও উইকএন্ডে ইউরোপের যে কোনো দেশে দু’দিন বেরিয়ে আসা মোটেও সমস্যা নয় । শুক্রবার কাজ শেষে এক্সপ্রেস ট্রেন ধরলে জার্মানীর গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে সে রাতেই পৌঁছা যায় । বিমানে হলে তো এক ঘন্টারও কম ।
বন্ধুদের বললাম, শুক্রবার রাতে আমি আসবো । তোদের ঠিকানা দে । ওরা বললো, ঠিকানা দেয়া লাগবে না । আমরা রেলওয়ে ষ্টেশনে থাকবো । তোকে রিসিভ করবো । ষ্টেশনের নাম জিজ্ঞাসা করতেই রফিক বললো, ড্রেসডেন । আমি চমকে উঠলাম । ড্রেসডেন সাবেক পূর্ব জার্মানীর দ্বিতীয় বৃহত্তম একটি বিখ্যাত শহর । সাবেক পূর্ব বার্লিনের পরই এই শহরের মর্যাদা । দুই জার্মানী একত্রিত হওয়ার পর আমি সে দেশে যাইনি । ওদের কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না জিজ্ঞাসা করতেই রফিক বললো, দোস্ত আজ বিশ দিন হয় তরকারি দিয়ে ভাত খেতে পারি না । তিন বেলা সরকারি খাবার দেয় । সবই ইউরোপিয়ান খাবার । দুই তিন রকমের ফলমুল । মাঝে মধ্যে বিভিন্ন আইটেমের সঙ্গে অল্প একটু ভাতও দেয় সঙ্গে মাংসও থাকে। কিন্তু শূয়োরের মাংস হতে পারে এই ভয়ে তাও খাই না । বললাম, খেয়ে ফেল । জান বাঁচানো ফরজ । চার বছর আগে এমন পরিস্থিতিতে আমিও পড়েছিলাম । ৩৩ দিন ভাত না খেয়ে পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম ।
আসিফ প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, দোস্ত ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য ইউরোপ এসেছি, এখন তো দেখছি না খেয়েই মারা যাবো । গতকাল রুই মাছের মতো একটা মাছ কিনেছি কিন্তু মশলার অভাবে তাও খেতে পারিনি । ফৃজে রেখে দিয়েছি । এখানে কিচ্ছু পাওয়া যায় না ।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন ? ফ্রাংকফুর্ট, মিউনিখ, বার্লিন, হাইডেলবার্গ, কোলন, নুরেমবার্গ, হামবুর্গ, হ্যানোভার, বন( সাবেক পশ্চিম জার্মানির রাজধানী ), ষ্টুটগার্টসহ সব শহরেই প্রচুর বাঙালি আছে এবং সব কিছুই পাওয়া যায় । আমি নিজে দেখেছি । আসিফ উত্তেজিতভাবে সমাজতন্ত্রকে ডজন খানেক গালি দিয়ে বললো, শালারা নিজেরাই খেতে পায় না । সর্বহারাদের পক্ষে বলতে গিয়ে ওরা নিজেরাই সর্বস্ব হারিয়েছে । জার্মানীর পশ্চিম অংশে গিয়ে কাজ করে । জার্মানীর পূর্ব অংশের বড় বড় সব ইনডাসট্রি জার্মান সরকার বন্ধ করে দিয়েছে । ওদের তৈরি পণ্যের কোয়ালিটি বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্যের চেয়েও খারাপ । এখানে কোনো কাজ নেই । ওরা নিজেরাই বেকার । দুই জার্মানী একত্রিত হওয়ার পর জার্মান সরকার আমাদের মতো আশ্রয় প্রার্থীদেরকে পূর্ব অংশে পাঠায় । এই অঞ্চলের লোকেরা ইংরেজির ই-ও জানে না । সমাজতন্ত্রের প্রতি আমার দুর্বলতা আছে । ত্রুটি যতোই থাক আদর্শ হিসেবে সমাজতন্ত্র নিঃসন্দেহে উন্নত ।
কথা না বাড়িয়ে বললাম, ঠিক আছে আমি টিকেট কেটে কখন এবং কতো নাম্বার প্ল্যাটফর্মে নামবো তোদের জানাবো ।
বৃহস্পতিবার জার্মানীর ভিসা নিয়ে চেক রিপাবলিকের ট্রানজিট ভিসাও নিতে হলো । ভিয়েনা থেকে প্রাগ ( চেক রিপাবলিকের রাজধানী )হয়ে ড্রেসডেন (Dresden) শর্টকাট রুট । আমি আগেই প্রাগ ঘুরে এসেছি তাই চেক রিপাবলিক দেশটা আমার পরিচিত । ইতিমধ্যেই চেকোস্লোভাকিয়া দুই দেশ হয়ে গেছে । চেক রিপাবলিক ও স্নোভাকিয়া । রাজধানী যথাক্রমে প্রাগ (Prague) ও ব্রাটিস্লাভা (Bratislava) । প্রাগ হয়ে ড্রেসডেন হফট্ বানহফ বা প্রধান রেলওয়ে ষ্টেশনের উনিশ নাম্বার প্ল্যাটফর্মে নেমেই দেখি ওরা দাঁড়িয়ে । দৌঁড়ে এসে বুকে জড়িয়ে ধরে উৎফুল্লভাবে জার্মানে বললো, ভিলকমেন, ভিলকমেন অর্থাৎ ওয়েলকাম ওয়েলকাম । দীর্ঘদিন পর একত্রিত হওয়ার উচ্ছাস শেষ করে বাস ধরে ওদের সরকারি বাড়িতে । ড্রেসডেন মূল শহর থেকে বাসে ত্রিশ মিনিটের জার্নি । ইউরোপে ত্রিশ মিনিটের জার্নি মানে ৪০/৫০ মাইল । মোটামুটি দূর ।
বাউন্ডারি দেয়াল ঘেরা অনেক বড় এলাকা নিয়ে গ্রামের স্কুলের মতো লম্বা কয়েকটি চারতলা বিল্ডিং। ভেতরে ফুটবল,টেনিস খেলার মাঠও আছে । সামনে অফিস । পাশেই পুলিশ ক্যাম্প । কে এলো কে গেলো সে ব্যাপারে পুলিশের কোনো দায়িত্ব নেই । ভেতরে কোনো দুর্ঘটনা বা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলেই পুলিশ হস্তক্ষেপ করে । পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রায় সহস্রাধিক মানুষের বাস এই বাড়িতে । সবাই আশ্রয় প্রার্থী । গেটের বাম দিকে লাগোয়া সিকিউরিটি অফিস । শিফট করে দু’জন সার্বক্ষণিক দায়িত্বে নিয়োজিত । ভেতর থেকে বাইরে যেতে হলে খাতায় এন্ট্রি করে স্লিপ নিয়ে যেতে হবে । ঢুকতেও তাই । বাইরের কোনো ভিজিটর ভেতরে যেতে হলে খাতায় দিন, তারিখ, সময়, উদ্দেশ্য, কার কাছে যাওয়া হচ্ছে তার নাম ও রুম নাম্বার লিখতে হবে । কোনো অবস্থাতেই ভিজিটর রাতে থাকতে পারবে না । এটা নিয়ম । তবে কর্তৃপক্ষের চোখে ফাঁকি দিয়ে দুই এক রাত ইচ্ছা করলে থাকা যায় ।
নিজের মাতৃভাষায় কোনো বিদেশী কথা বললে এই পৃথিবীর সব মানুষ খুশি হয় । আমি যে দেশে থাকি সে দেশের ভাষাও জার্মান । সিকিউরিটি দু’জনকে বুঝিয়ে বললাম, আমরা ছাত্র জীবনের বন্ধু । আমি ভিয়েনা থেকে এসেছি । এক সঙ্গে কিছু সময় কাটিয়ে আবার চলে যাবো । দু’জন আমাদের ফ্রেন্ডশিপের প্রশংসা করে বললেন, পাসপোর্ট জমা দিয়ে যাও । ফেরার পথে নিয়ে যেও ।
বিল্ডিংটা কেমন যেন গুদাম গুদাম ভাব । পরে শুনেছি, দুই জার্মানী একত্রিত হওয়ার আগ পর্যন্ত এটি সভিয়েট আর্মি ক্যাম্প ছিল । বন্ধুদের রুম চার তলায় । সিঁড়িতে আসিফ বললো, আমাদের রুম নাম্বারটা কুফা । উপরে উঠে চমকে উঠলাম । রুম নাম্বার ফোর টোয়েনটি ।
ছোট্ট ট্রাভেল ব্যাগ খুলে ওদের জন্য নেয়া সামান্য গিফটসহ মশলাপাতিও বের করলাম । ফান করে বললাম, আই আম টেম্পটেড টু ডিক্লেয়ার মাইসেলফ এ গুড কুক। এ ধরনের এসাইলাম শেল্টারে রুমে রান্না করার কোনো ব্যবস্থা নেই । যারা ফ্যামিলিসহ আছে এবং যাদের ছোট সন্তান আছে শুধু তাদের রুমে বাচ্চার প্রয়োজনে ইলেকট্রিক হিটার ব্যবহার করার অনুমতি আছে । তবে হিটার কিনতে হবে নিজের পয়সায় । প্রত্যেক রুমেই একটি করে ফ্যামিলি সাইজ রেফ্রিজারেটর আছে । পাশেই মাঝারি সাইজের বেসিন । নিচ তলায় লবিতে অনেকগুলো হিটার আছে পাশাপাশি । যৌথভাবে যে কেউ এগুলো ব্যবহার করতে পারে । যদিও অনেকেই নিজ পয়সা খরচ করে হিটার কিনে নিয়েছে এবং চুরি করে রুমে তা ব্যবহার করে । এ ব্যাপারে আমার বন্ধুরা ফার্ষ্ট । অসিফকে বললাম, তোর রুই মাছের মতো মাছটা বের কর । আমি রান্না করবো । কিন্তু ওদের পাতিল নেই । একটা সসপ্যান আছে মাত্র । উল্টো দিকের রুমে তুরস্কের একটি ফ্যামিলি থাকে ।
রফিক ওদের কাছ থেকে পাতিল ধার আনতে গেল । এই ফাঁকে আসিফ ফিশফিশ করে কানের কাছে এসে বললো, দোস্ত আমাদের পাশের রুমে রুমানিয়ার একটি মেয়ে থাকে । যা সুন্দর না ! দেখলে মাথা ঘুরে যায় । মেয়েটা খুব মিশুক । ভালো জার্মান বলে । ভাষার জন্য সুবিধা করতে পারছি না । তুই একটু কথা বলে দেখ ট্র্যাপে পড়ে কিনা । রফিকও ইন্টারেষ্টেড । ওকে বলিস না । তখনি রফিক রুমে ঢুকলো । তার ডান হাতে দু'টো ছোট পাতিল । বাম হাতে বুকের সঙ্গে লাগিয়ে তিনটি ব্যাকস (Becks) বিয়ার । ব্যাকস জার্মানির ভালো বিয়ার। হাইনিক্যান বা অন্য বিয়ারের তুলনায় একটু তিতা।
পাতিল দুটো নিচে রেখে বিজ্ঞাপনের ভাষায় বললো, দোস্ত জার্মানীর ভালো বিয়ার । হলান্ডের হাইনিক্যানের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় । নিজে একটা রেখে আমাদের দু'জনের হাতে দুটো ধরিয়ে দিয়ে বললো, দশ মিনিট আমি আসছি ।
তেল গরম করে পেঁয়াজ, রসুন দিয়ে একটি কাপে মরিচ, হলুদ, জিরা, ফিশ মশলা, কারি পাউডার সামান্য গরম পানি দিয়ে মিক্স করছি । আসিফ দরজায় দাঁড়িয়ে করিডোরে কি যেন দেখছে । হঠাৎ সে হন্তদন্ত হয়ে এসে বললো, দোস্ত মেয়েটা বেরিয়েছে । তুই জার্মানে দুই একটা কথা বল প্লিজ ।
রীতিমতো অনুনয় বিনয় । পেয়াজ, রসুন, তেলের সঙ্গে মশলা ঢেলে দিয়ে ওকে বললাম, তুই একটু দেখিস । মাঝে মাঝে খুন্তি দিয়ে নাড়া দিস নয়তো মশলা পুড়ে যাবে । সে উৎফুলভাবে বললো, নো প্রবলেম । বাইরে এসে দেখি হালকা গোলাপি রঙের শর্টস আর নেভি ব্লু জিন্স শার্ট পরে সিঁড়ির রেলিং ধরে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে । শর্টস-এর রঙের সঙ্গে মেয়েটির গায়ের রং এমনভাবে মিশে গেছে হঠাৎ দেখলে মনে হবে যেন মেয়েটি উলঙ্গ । বাকল ছাড়ানো কলা গাছের মতো মসৃণ তার দুটো পা । তখন রাত একটা । এই বাড়ির কেউ তখনো ঘুমোয়নি । আমি মেয়েটির সঙ্গে হাইহ্যালো বলে জার্মানে কথা শুরু করলাম । দুজন বিদেশী তৃতীয় কোনো ভাষায় কথা বললে উভয়ে উভয়কে সহজে বুঝতে পারে । মেয়েটির নাম গাব্রিয়েলা । চাউসেস্কুর পতনের পর ইলিয়াসকোর শাসন আমল কেমন ? সমাজতন্ত্রের কেন এই করুণ পরিণতি- এসব আরো অনেক আলোচনা জমে উঠেছে । রান্নার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছি । আসিফ দরজায় দাঁড়িয়ে আমাদেরকে ফলো করছে । একটু পরেই ঘটলো অঘটন ।
ঠুস করে একটা আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গেই চারতলার ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। দৌঁড়ে রুমে এসে লাইটার জ্বালিয়ে দেখি মশলা শুকিয়ে পুড়ে শেষ । হিটারও জ্বলে গেছে । সারা রুম গন্ধে গন্ধময় । বুঝলাম, আমাদের রুমের শর্টসার্কিটেই চারতলায় লোড শেডিং। রফিকও এলো । বিরক্ত হয়ে আসিফকে বললাম, সব নষ্টের মূল তুই। সে কিছুক্ষণ আগের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে বললো, তুই আমার পছন্দের মেয়ের সঙ্গে ফিল্ডিং মারতে গিয়ে এই ঘটনা ঘটিয়েছিস ।
কিছুক্ষণ পর মাননীয় পুলিশ এসে হাজির । কিভাবে ঘটনা ঘটেছে ? কেন ঘটেছে ? উদ্দেশ্য কি ? ইচ্ছাকৃত না দুর্ঘটনা ? এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারা ? অপরাধী কে ? রুমে রান্না করা বেআইনি স্মরণ করিয়ে দিয়ে আমাদের ফটো আইডি দেখতে চাইলো ।
ভেগে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমি ধরা পড়ে গেলাম । আমার আইডি নেই। পাসপোর্ট গেটে জমা । আমি কে? কি? এখানে কেন? উদ্দেশ্য কি? দেশ কোথায়? কি করি? অসংখ্য প্রশ্ন । অ্যাপিল করার অগেই পুলিশি সিদ্ধান্ত, আমাকে থানায় যেতে হবে । আমার অপরাধ গুরুতর । প্রথমত: আমি জার্মানীতে থাকি না । দ্বিতীয়ত: সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে আমি এসাইলাম শেল্টারে রাত যাপন করছি । তৃতীয়ত: এই দুর্ঘটনার জন্য আমি এককভাবে দায়ী । কারণ আমি অনাহুত । দুই বন্ধুকে আস্তে বাংলায় বললাম, তোরা চিন্তা করিস না । এদেশের নিয়ম অনুযায়ী আমার কয়েক টাকা ফাইন হবে । এর বেশি কিছু নয় । একজন পুলিশ কড়া ধমক দিয়ে বললো, জার্মান ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় কথা বলা যাবে না । গেট থেকে পাসপোর্ট নিয়ে চেকোস্লোভাকিয়ার তৈরি স্কোদা(Skoda) পুলিশের গাড়ির পেছনের সিটে বসলাম । বিশ মিনিটে থানায় ।
একটি রুমে ঘন্টাখানেক বসিয়ে রাখার পর মধ্যবয়সী একজন উর্ধ্বতন পুলিশ অফিসার এলেন । কিছু প্রশ্ন করলেন । উত্তর দিলাম । এরপর তিনি প্রকৃত ঘটনা জানতে চাইলে অনেষ্টলি ভিয়েনা থেকে আমার জার্মানিতে আসার কারণসহ দুর্ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মেয়েটির কথাও খোলাখুলি বললাম । তিনি আমার পাসপোর্টে ভিসা দেখছিলেন । ঘটনার বিস্তারিত শুনে তিনি উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে বললেন, এটি একটি চমৎকার গল্প । কিন্তু আমাকে তিনি ক্ষমা করতে পারলেন না বলে দু:খ প্রকাশ করে বললেন, একশ চৌত্রিশ জার্মান মার্ক জরিমানা দিয়ে দিলেই সমস্যা শেষ । বেআইনিভাবে এসাইলাম শেল্টারে রাত যাপনের ফাইন ।
আরেকজন পুলিশ রিসিপ্ট লিখে দিলে আমি গুনে গুনে টাকা দিলাম । উর্ধ্বতন অফিসারের নির্দেশে পরবর্তী রাত বন্ধুদের সঙ্গে থাকার অনুমতি পেলাম । ভবিষ্যতে যেন এমন আর না করি উপদেশ দিলেন । ভোর চারটায় দু'জন পুলিশ আবারো আমাকে সেখানে পৌঁছে দিল যেখান থেকে নিয়েছিল।
(করিম চৌধুরী)
০৫. ০৫. ১৯৯৮
নিউ ইয়র্ক
ইমেল:karimcbd@gmail.com
করিম চৌধুরী
আমরা যারা ব্যাচেলর এবং বিদেশে থাকি এবং যারা বিবাহিত অথচ স্ত্রী দেশে থাকে রান্না তাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ । এই মহা বিরক্তিকর কাজে ফাঁকি দেয়ার কোনো সুযোগ নেই । চেষ্টা করে দেখেছি । লাভ হয়নি । ম্যাকডোনাল্ডস, হটডগ, বার্গার কিং, পিৎসা, স্টেক, কেএফসি কাহাতক সহ্য হয় । তবে রান্নার কারণে ঘন্টা খানেক হাজতবাস আমার কাছে ঐতিহাসিক ঘটনার মতোই । ফ্র্যাংকলি বললে ঘটনাটি এ রকম ।
তখন ইউরোপে থাকি । চার বছর আগের কথা । ( মানে ১৯৯৪ সালে । এখন থেকে ২৪ বছর আগের কথা) দেশ থেকে দু’জন বন্ধু পোল্যান্ড হয়ে জার্মানী এসেছে । রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে সরকারি বাড়িতে ফৃ থাকা খাওয়া ও চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত সাময়িকভাবে হয়েছে । ফোনে আমার সঙ্গে যোগাযোগ হলো । বললো, দোস্ত পারলে একবার আয় । আমার ভাগ্য কিছুটা ভালো ছিল । জার্মানীর প্রতিবেশী দেশ অস্টৃয়াতে তখন আমার ওয়ার্ক অথরাইজেশনসহ পারমানেন্ট রেসিডেন্ট পারমিট আছে । ভালো বেতনের ভালো একটি চাকরিও আছে । দিনে আট ঘন্টা ডিউটি । সপ্তাহে দু’দিন ছুটি । যে কোনো অ্যামবাসিতে ভিসা চাইলে কর্তৃপক্ষ কৃতজ্ঞ হয়ে যান । ছুটি না নিয়েও উইকএন্ডে ইউরোপের যে কোনো দেশে দু’দিন বেরিয়ে আসা মোটেও সমস্যা নয় । শুক্রবার কাজ শেষে এক্সপ্রেস ট্রেন ধরলে জার্মানীর গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে সে রাতেই পৌঁছা যায় । বিমানে হলে তো এক ঘন্টারও কম ।
বন্ধুদের বললাম, শুক্রবার রাতে আমি আসবো । তোদের ঠিকানা দে । ওরা বললো, ঠিকানা দেয়া লাগবে না । আমরা রেলওয়ে ষ্টেশনে থাকবো । তোকে রিসিভ করবো । ষ্টেশনের নাম জিজ্ঞাসা করতেই রফিক বললো, ড্রেসডেন । আমি চমকে উঠলাম । ড্রেসডেন সাবেক পূর্ব জার্মানীর দ্বিতীয় বৃহত্তম একটি বিখ্যাত শহর । সাবেক পূর্ব বার্লিনের পরই এই শহরের মর্যাদা । দুই জার্মানী একত্রিত হওয়ার পর আমি সে দেশে যাইনি । ওদের কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না জিজ্ঞাসা করতেই রফিক বললো, দোস্ত আজ বিশ দিন হয় তরকারি দিয়ে ভাত খেতে পারি না । তিন বেলা সরকারি খাবার দেয় । সবই ইউরোপিয়ান খাবার । দুই তিন রকমের ফলমুল । মাঝে মধ্যে বিভিন্ন আইটেমের সঙ্গে অল্প একটু ভাতও দেয় সঙ্গে মাংসও থাকে। কিন্তু শূয়োরের মাংস হতে পারে এই ভয়ে তাও খাই না । বললাম, খেয়ে ফেল । জান বাঁচানো ফরজ । চার বছর আগে এমন পরিস্থিতিতে আমিও পড়েছিলাম । ৩৩ দিন ভাত না খেয়ে পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম ।
আসিফ প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, দোস্ত ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য ইউরোপ এসেছি, এখন তো দেখছি না খেয়েই মারা যাবো । গতকাল রুই মাছের মতো একটা মাছ কিনেছি কিন্তু মশলার অভাবে তাও খেতে পারিনি । ফৃজে রেখে দিয়েছি । এখানে কিচ্ছু পাওয়া যায় না ।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন ? ফ্রাংকফুর্ট, মিউনিখ, বার্লিন, হাইডেলবার্গ, কোলন, নুরেমবার্গ, হামবুর্গ, হ্যানোভার, বন( সাবেক পশ্চিম জার্মানির রাজধানী ), ষ্টুটগার্টসহ সব শহরেই প্রচুর বাঙালি আছে এবং সব কিছুই পাওয়া যায় । আমি নিজে দেখেছি । আসিফ উত্তেজিতভাবে সমাজতন্ত্রকে ডজন খানেক গালি দিয়ে বললো, শালারা নিজেরাই খেতে পায় না । সর্বহারাদের পক্ষে বলতে গিয়ে ওরা নিজেরাই সর্বস্ব হারিয়েছে । জার্মানীর পশ্চিম অংশে গিয়ে কাজ করে । জার্মানীর পূর্ব অংশের বড় বড় সব ইনডাসট্রি জার্মান সরকার বন্ধ করে দিয়েছে । ওদের তৈরি পণ্যের কোয়ালিটি বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্যের চেয়েও খারাপ । এখানে কোনো কাজ নেই । ওরা নিজেরাই বেকার । দুই জার্মানী একত্রিত হওয়ার পর জার্মান সরকার আমাদের মতো আশ্রয় প্রার্থীদেরকে পূর্ব অংশে পাঠায় । এই অঞ্চলের লোকেরা ইংরেজির ই-ও জানে না । সমাজতন্ত্রের প্রতি আমার দুর্বলতা আছে । ত্রুটি যতোই থাক আদর্শ হিসেবে সমাজতন্ত্র নিঃসন্দেহে উন্নত ।
কথা না বাড়িয়ে বললাম, ঠিক আছে আমি টিকেট কেটে কখন এবং কতো নাম্বার প্ল্যাটফর্মে নামবো তোদের জানাবো ।
বৃহস্পতিবার জার্মানীর ভিসা নিয়ে চেক রিপাবলিকের ট্রানজিট ভিসাও নিতে হলো । ভিয়েনা থেকে প্রাগ ( চেক রিপাবলিকের রাজধানী )হয়ে ড্রেসডেন (Dresden) শর্টকাট রুট । আমি আগেই প্রাগ ঘুরে এসেছি তাই চেক রিপাবলিক দেশটা আমার পরিচিত । ইতিমধ্যেই চেকোস্লোভাকিয়া দুই দেশ হয়ে গেছে । চেক রিপাবলিক ও স্নোভাকিয়া । রাজধানী যথাক্রমে প্রাগ (Prague) ও ব্রাটিস্লাভা (Bratislava) । প্রাগ হয়ে ড্রেসডেন হফট্ বানহফ বা প্রধান রেলওয়ে ষ্টেশনের উনিশ নাম্বার প্ল্যাটফর্মে নেমেই দেখি ওরা দাঁড়িয়ে । দৌঁড়ে এসে বুকে জড়িয়ে ধরে উৎফুল্লভাবে জার্মানে বললো, ভিলকমেন, ভিলকমেন অর্থাৎ ওয়েলকাম ওয়েলকাম । দীর্ঘদিন পর একত্রিত হওয়ার উচ্ছাস শেষ করে বাস ধরে ওদের সরকারি বাড়িতে । ড্রেসডেন মূল শহর থেকে বাসে ত্রিশ মিনিটের জার্নি । ইউরোপে ত্রিশ মিনিটের জার্নি মানে ৪০/৫০ মাইল । মোটামুটি দূর ।
বাউন্ডারি দেয়াল ঘেরা অনেক বড় এলাকা নিয়ে গ্রামের স্কুলের মতো লম্বা কয়েকটি চারতলা বিল্ডিং। ভেতরে ফুটবল,টেনিস খেলার মাঠও আছে । সামনে অফিস । পাশেই পুলিশ ক্যাম্প । কে এলো কে গেলো সে ব্যাপারে পুলিশের কোনো দায়িত্ব নেই । ভেতরে কোনো দুর্ঘটনা বা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলেই পুলিশ হস্তক্ষেপ করে । পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রায় সহস্রাধিক মানুষের বাস এই বাড়িতে । সবাই আশ্রয় প্রার্থী । গেটের বাম দিকে লাগোয়া সিকিউরিটি অফিস । শিফট করে দু’জন সার্বক্ষণিক দায়িত্বে নিয়োজিত । ভেতর থেকে বাইরে যেতে হলে খাতায় এন্ট্রি করে স্লিপ নিয়ে যেতে হবে । ঢুকতেও তাই । বাইরের কোনো ভিজিটর ভেতরে যেতে হলে খাতায় দিন, তারিখ, সময়, উদ্দেশ্য, কার কাছে যাওয়া হচ্ছে তার নাম ও রুম নাম্বার লিখতে হবে । কোনো অবস্থাতেই ভিজিটর রাতে থাকতে পারবে না । এটা নিয়ম । তবে কর্তৃপক্ষের চোখে ফাঁকি দিয়ে দুই এক রাত ইচ্ছা করলে থাকা যায় ।
নিজের মাতৃভাষায় কোনো বিদেশী কথা বললে এই পৃথিবীর সব মানুষ খুশি হয় । আমি যে দেশে থাকি সে দেশের ভাষাও জার্মান । সিকিউরিটি দু’জনকে বুঝিয়ে বললাম, আমরা ছাত্র জীবনের বন্ধু । আমি ভিয়েনা থেকে এসেছি । এক সঙ্গে কিছু সময় কাটিয়ে আবার চলে যাবো । দু’জন আমাদের ফ্রেন্ডশিপের প্রশংসা করে বললেন, পাসপোর্ট জমা দিয়ে যাও । ফেরার পথে নিয়ে যেও ।
বিল্ডিংটা কেমন যেন গুদাম গুদাম ভাব । পরে শুনেছি, দুই জার্মানী একত্রিত হওয়ার আগ পর্যন্ত এটি সভিয়েট আর্মি ক্যাম্প ছিল । বন্ধুদের রুম চার তলায় । সিঁড়িতে আসিফ বললো, আমাদের রুম নাম্বারটা কুফা । উপরে উঠে চমকে উঠলাম । রুম নাম্বার ফোর টোয়েনটি ।
ছোট্ট ট্রাভেল ব্যাগ খুলে ওদের জন্য নেয়া সামান্য গিফটসহ মশলাপাতিও বের করলাম । ফান করে বললাম, আই আম টেম্পটেড টু ডিক্লেয়ার মাইসেলফ এ গুড কুক। এ ধরনের এসাইলাম শেল্টারে রুমে রান্না করার কোনো ব্যবস্থা নেই । যারা ফ্যামিলিসহ আছে এবং যাদের ছোট সন্তান আছে শুধু তাদের রুমে বাচ্চার প্রয়োজনে ইলেকট্রিক হিটার ব্যবহার করার অনুমতি আছে । তবে হিটার কিনতে হবে নিজের পয়সায় । প্রত্যেক রুমেই একটি করে ফ্যামিলি সাইজ রেফ্রিজারেটর আছে । পাশেই মাঝারি সাইজের বেসিন । নিচ তলায় লবিতে অনেকগুলো হিটার আছে পাশাপাশি । যৌথভাবে যে কেউ এগুলো ব্যবহার করতে পারে । যদিও অনেকেই নিজ পয়সা খরচ করে হিটার কিনে নিয়েছে এবং চুরি করে রুমে তা ব্যবহার করে । এ ব্যাপারে আমার বন্ধুরা ফার্ষ্ট । অসিফকে বললাম, তোর রুই মাছের মতো মাছটা বের কর । আমি রান্না করবো । কিন্তু ওদের পাতিল নেই । একটা সসপ্যান আছে মাত্র । উল্টো দিকের রুমে তুরস্কের একটি ফ্যামিলি থাকে ।
রফিক ওদের কাছ থেকে পাতিল ধার আনতে গেল । এই ফাঁকে আসিফ ফিশফিশ করে কানের কাছে এসে বললো, দোস্ত আমাদের পাশের রুমে রুমানিয়ার একটি মেয়ে থাকে । যা সুন্দর না ! দেখলে মাথা ঘুরে যায় । মেয়েটা খুব মিশুক । ভালো জার্মান বলে । ভাষার জন্য সুবিধা করতে পারছি না । তুই একটু কথা বলে দেখ ট্র্যাপে পড়ে কিনা । রফিকও ইন্টারেষ্টেড । ওকে বলিস না । তখনি রফিক রুমে ঢুকলো । তার ডান হাতে দু'টো ছোট পাতিল । বাম হাতে বুকের সঙ্গে লাগিয়ে তিনটি ব্যাকস (Becks) বিয়ার । ব্যাকস জার্মানির ভালো বিয়ার। হাইনিক্যান বা অন্য বিয়ারের তুলনায় একটু তিতা।
পাতিল দুটো নিচে রেখে বিজ্ঞাপনের ভাষায় বললো, দোস্ত জার্মানীর ভালো বিয়ার । হলান্ডের হাইনিক্যানের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় । নিজে একটা রেখে আমাদের দু'জনের হাতে দুটো ধরিয়ে দিয়ে বললো, দশ মিনিট আমি আসছি ।
তেল গরম করে পেঁয়াজ, রসুন দিয়ে একটি কাপে মরিচ, হলুদ, জিরা, ফিশ মশলা, কারি পাউডার সামান্য গরম পানি দিয়ে মিক্স করছি । আসিফ দরজায় দাঁড়িয়ে করিডোরে কি যেন দেখছে । হঠাৎ সে হন্তদন্ত হয়ে এসে বললো, দোস্ত মেয়েটা বেরিয়েছে । তুই জার্মানে দুই একটা কথা বল প্লিজ ।
রীতিমতো অনুনয় বিনয় । পেয়াজ, রসুন, তেলের সঙ্গে মশলা ঢেলে দিয়ে ওকে বললাম, তুই একটু দেখিস । মাঝে মাঝে খুন্তি দিয়ে নাড়া দিস নয়তো মশলা পুড়ে যাবে । সে উৎফুলভাবে বললো, নো প্রবলেম । বাইরে এসে দেখি হালকা গোলাপি রঙের শর্টস আর নেভি ব্লু জিন্স শার্ট পরে সিঁড়ির রেলিং ধরে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে । শর্টস-এর রঙের সঙ্গে মেয়েটির গায়ের রং এমনভাবে মিশে গেছে হঠাৎ দেখলে মনে হবে যেন মেয়েটি উলঙ্গ । বাকল ছাড়ানো কলা গাছের মতো মসৃণ তার দুটো পা । তখন রাত একটা । এই বাড়ির কেউ তখনো ঘুমোয়নি । আমি মেয়েটির সঙ্গে হাইহ্যালো বলে জার্মানে কথা শুরু করলাম । দুজন বিদেশী তৃতীয় কোনো ভাষায় কথা বললে উভয়ে উভয়কে সহজে বুঝতে পারে । মেয়েটির নাম গাব্রিয়েলা । চাউসেস্কুর পতনের পর ইলিয়াসকোর শাসন আমল কেমন ? সমাজতন্ত্রের কেন এই করুণ পরিণতি- এসব আরো অনেক আলোচনা জমে উঠেছে । রান্নার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছি । আসিফ দরজায় দাঁড়িয়ে আমাদেরকে ফলো করছে । একটু পরেই ঘটলো অঘটন ।
ঠুস করে একটা আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গেই চারতলার ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। দৌঁড়ে রুমে এসে লাইটার জ্বালিয়ে দেখি মশলা শুকিয়ে পুড়ে শেষ । হিটারও জ্বলে গেছে । সারা রুম গন্ধে গন্ধময় । বুঝলাম, আমাদের রুমের শর্টসার্কিটেই চারতলায় লোড শেডিং। রফিকও এলো । বিরক্ত হয়ে আসিফকে বললাম, সব নষ্টের মূল তুই। সে কিছুক্ষণ আগের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে বললো, তুই আমার পছন্দের মেয়ের সঙ্গে ফিল্ডিং মারতে গিয়ে এই ঘটনা ঘটিয়েছিস ।
কিছুক্ষণ পর মাননীয় পুলিশ এসে হাজির । কিভাবে ঘটনা ঘটেছে ? কেন ঘটেছে ? উদ্দেশ্য কি ? ইচ্ছাকৃত না দুর্ঘটনা ? এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারা ? অপরাধী কে ? রুমে রান্না করা বেআইনি স্মরণ করিয়ে দিয়ে আমাদের ফটো আইডি দেখতে চাইলো ।
ভেগে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমি ধরা পড়ে গেলাম । আমার আইডি নেই। পাসপোর্ট গেটে জমা । আমি কে? কি? এখানে কেন? উদ্দেশ্য কি? দেশ কোথায়? কি করি? অসংখ্য প্রশ্ন । অ্যাপিল করার অগেই পুলিশি সিদ্ধান্ত, আমাকে থানায় যেতে হবে । আমার অপরাধ গুরুতর । প্রথমত: আমি জার্মানীতে থাকি না । দ্বিতীয়ত: সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে আমি এসাইলাম শেল্টারে রাত যাপন করছি । তৃতীয়ত: এই দুর্ঘটনার জন্য আমি এককভাবে দায়ী । কারণ আমি অনাহুত । দুই বন্ধুকে আস্তে বাংলায় বললাম, তোরা চিন্তা করিস না । এদেশের নিয়ম অনুযায়ী আমার কয়েক টাকা ফাইন হবে । এর বেশি কিছু নয় । একজন পুলিশ কড়া ধমক দিয়ে বললো, জার্মান ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় কথা বলা যাবে না । গেট থেকে পাসপোর্ট নিয়ে চেকোস্লোভাকিয়ার তৈরি স্কোদা(Skoda) পুলিশের গাড়ির পেছনের সিটে বসলাম । বিশ মিনিটে থানায় ।
একটি রুমে ঘন্টাখানেক বসিয়ে রাখার পর মধ্যবয়সী একজন উর্ধ্বতন পুলিশ অফিসার এলেন । কিছু প্রশ্ন করলেন । উত্তর দিলাম । এরপর তিনি প্রকৃত ঘটনা জানতে চাইলে অনেষ্টলি ভিয়েনা থেকে আমার জার্মানিতে আসার কারণসহ দুর্ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মেয়েটির কথাও খোলাখুলি বললাম । তিনি আমার পাসপোর্টে ভিসা দেখছিলেন । ঘটনার বিস্তারিত শুনে তিনি উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে বললেন, এটি একটি চমৎকার গল্প । কিন্তু আমাকে তিনি ক্ষমা করতে পারলেন না বলে দু:খ প্রকাশ করে বললেন, একশ চৌত্রিশ জার্মান মার্ক জরিমানা দিয়ে দিলেই সমস্যা শেষ । বেআইনিভাবে এসাইলাম শেল্টারে রাত যাপনের ফাইন ।
আরেকজন পুলিশ রিসিপ্ট লিখে দিলে আমি গুনে গুনে টাকা দিলাম । উর্ধ্বতন অফিসারের নির্দেশে পরবর্তী রাত বন্ধুদের সঙ্গে থাকার অনুমতি পেলাম । ভবিষ্যতে যেন এমন আর না করি উপদেশ দিলেন । ভোর চারটায় দু'জন পুলিশ আবারো আমাকে সেখানে পৌঁছে দিল যেখান থেকে নিয়েছিল।
(করিম চৌধুরী)
০৫. ০৫. ১৯৯৮
নিউ ইয়র্ক
ইমেল:karimcbd@gmail.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন