(যায়যায়দিনের "বর্ষা" নিয়ে বিশেষ সংখ্যায় এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিলো
১৯৯৯ সালের আগস্ট মাসে । নিউ ইয়র্ক থেকে লিখেছিলাম । পড়ার সময় মনে রাখতে
হবে এটা ১৯ বছর আগের লেখা । ফেসবুকের নাম
গন্ধও ছিলো না তখন । নয়তো বিভ্রান্তি হতে পারে । এখন বৃষ্টি বৃষ্টি নেমেছে ।
তাই বৃষ্টি নিয়ে এই স্মৃতিকথা । মা'র প্রসঙ্গ আছে তাই ছাত্র জীবনে মায়ের
সঙ্গে একটা ছবি ।)
দেশে বিদেশে
করিম চৌধুরী
ছাত্র জীবনে বর্ষা নামের একটি প্রবন্ধ আমাদের পাঠ্য ছিল । লেখক প্রমথ চৌধুরী । লেখকের নামটি লিখতে এবং বলতে প্রায়ই ভুল করতাম । আমি বলতাম প্রথম চৌধুরী । সহপাঠীদের ইয়ার্কি আর স্যারদের তিরষ্কার এ জন্য কম সহ্য করতে হয়নি । সহপাঠীরা কিছু দিন আমাকে প্রথম চৌধুরী বলেও ডেকেছিলো ।
চার বছর আগে ইউরোপ থেকে দেশে গিয়েছিলাম বেড়াতে । গ্রামের বাড়ীতে কয়েকদিন ছিলাম । এক দুপুরে ঝম ঝম শব্দে বৃষ্টি নামলো । কিছুক্ষণের মধ্যেই রোদ বৃষ্টি শুরু । শর্টস পরে দৌঁড়ে পুকুর পাড়ে এসে দাঁড়ালাম । অনেকক্ষণ ভিজে যখন শীত শীত লাগছিলো তখন ঘরে এসে শরীর মুছছি, এমন সময় আমার প্রয়াত প্রিয় মা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, বাড়ির সবাই বলাবলি করছে, তুই নাকি বিদেশে থেকে পাগল হয়ে গেছিস । কোনো সুস্থ মানুষ বিনা প্রয়োজনে এভাবে বৃষ্টিতে ভেজে ? আমার কাছে ছোট হলেও অন্যদের চোখে তুই বড় হয়েছিস । এখনো কেন হাফপ্যান্ট পরিস ? তুই কি ফুটবল খেলোয়াড় ?
মাকে রাগানোর জন্য আমি বললাম-মা, গরমের দিন হাফপ্যান্ট পড়তে বেশ মজা । বিদেশে তোমার মতো বৃদ্ধারাও হাফপ্যান্ট পরে ঘুরে বেড়ায় । আমাদের দেশে তো তুমি হাফপ্যান্ট পরে ঘুরতে পারবে না । আমার বেশ কয়েকটি হাফপ্যান্ট আছে । রাতে তুমি একটা হাফপ্যান্ট পরে ঘুমিয়ে দেখো কি মজা ! মা অবাক হয়ে বললেন-তওবা তওবা, নাউজুবিল্লাহ ! তুই এ সব কি বলিস ? এখন তো বাড়ির মানুষের মতো আমারো সন্দেহ হইতেছে। তোর মাথা ঠিক আছে?
টাওয়েল দিয়ে শরীর মুছতে মুছতে মা আমার চুল টেনে আদর করে বললেন,আমার পেটে যে এমন বান্দর হইবো তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।
মনে আছে ছোট বেলার কথা । ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে শিলাবৃষ্টির সময় কাঁচা আম ঝরে পড়তো । ঝড়বৃষ্টির পর প্রকৃতি শান্ত হলেও আমরা অবুঝ বালকরা হতাম অশান্ত । ব্যাগ নিয়ে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে আম কুড়োতাম । সমবয়সীদের সঙ্গে কখনো কখনো আম নিয়ে কাড়াকাড়ি থেকে মারামারি পর্যন্ত হতো । সারা শরীর কাদায় কাদাময় ।
বোন, ভাবীরা আমের ভর্তা বানিয়ে নিজেরা বেশিটুকু রেখে আমাদেরকে সামান্য দিতেন । বেশির জন্য কান্নাকাটি করেও কোনো লাভ হয়নি । ধমকের সুরে উপদেশ দিয়ে বলতেন, ছেলেদের বেশি টক খাওয়া ভালো না ।
আর ছিল চুরি। এটা তো মাষ্ট। বেশ কয়েক ঘন্টা বৃষ্টির পর আমরা বেরিয়ে পড়তাম মাছ চুরির অভিযানে । পুকুর, ডোবা ও ক্ষেতের অতিরিক্ত পানি যেখান দিয়ে বের হয়ে যেতো সেখানে পানির স্রোতের উলটো দিকে উঠে আসতো বিভিন্ন রকমের মাছ । কৈ, শিং, মাগুর, টাকি, টেংরা, শোল কখনো কখনো বোয়াল মাছও পাওয়া যেতো । কৈ মাছ তো কান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাঙায় চলে আসতো । চুরি এই জন্য যে, ওই সব পুকুর, ডোবা ও ক্ষেতের মালিক ছাড়া অন্য কেউ এই মাছ ধরতে পারবে না বলে অলিখিত নিয়ম ছিল । কিন্তু দূরন্ত বালকদের কে রুখে ? শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসের ইন্দ্রনাথকেও আমরা হারিয়ে দিতাম ।
এতোসব মধুর স্মৃতির সব কিছুকেই ম্লান করে দিয়েছিল বর্ষা বা বৃষ্টি নামের দৈত্য এক মহা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ১৯৮৮ সালে । সেই করুণ, মর্মস্পর্শী আর হৃদয়বিদারক স্মৃতি আজো মন থেকে মুছে যায়নি । বৃষ্টির পানি জমে ঢাকা ইউনিভার্সিটির জগন্নাথ হলের ছাদ ধসে সম্ভাবনাময় এতো অধিক সংখ্যক ছাত্রের এক সঙ্গে মৃত্যু দেশের ইতিহাসে আজো প্রথম । আজো চোখের সামনে ভেসে উঠে সেই বীভৎস ছবি । দেশ হারিয়ে ছিল অনেক সম্ভাবনাময় নাগরিককে । বাবা মা হারিয়ে ছিলেন ইউনির্ভার্সিটিতে পড়ুয়া তরতাজা সন্তানকে । শিক্ষক হারিয়ে ছিলেন প্রিয় ছাত্রদেরকে । প্রেমিকা হারিয়েছিলো তার প্রেমিককে । আমরা হারিয়ে ছিলাম সহপাঠী বন্ধুকে ।
আশ্চর্যের বিষয় হলো-এই মর্মান্তিক ঘটনার সময়ও কিছু রাজনীতিবিদ ব্যস্ত ছিলেন সামরিক প্রেসিডেন্ট এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ইস্যু তৈরি নিয়ে । সেদিন জেনারেল এরশাদ বাহামার রাজধানী নাসাউ-এ ছিলেন । সেখান থেকে জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে তার নিউ ইয়র্ক আসার কথা ছিল । খুব সম্ভব বিরোধী রাজনীতিকদের ইস্যু থেকে বঞ্চিত করার জন্য তিনি নিউ ইয়র্ক না এসে তড়িঘড়ি করে দেশে ফিরে যান ।
জগন্নাথ হলের প্রায় সব ছাত্রই ছিল হিন্দু ধর্মের । সেটাতেও রাজনীতিবিদরা সাম্প্রদায়িক রঙ মাখাতে চেয়েছিলেন ।
গত বছর নিউ ইয়র্কে বইমেলা উপলক্ষে দেশের জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, টিনের চালে ঝম ঝম করে বৃষ্টি পড়ার শব্দ আর ব্যাঙের ডাক শুনতে আমেরিকা ছেড়ে বাংলাদেশে চলে গেছি । আমেরিকাতেও প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় । যদিও আমাদের মতো বর্ষা ঋতু তাদের নেই । টিনের চালে বৃষ্টির ঝম ঝম শব্দ আর ব্যাঙের ডাক এখানে শুনতে পাইনি । কারণ এখানে টিনের ঘর নেই । ব্যাঙ থাকলেও ব্যাঙের ডাক কখনো শুনিনি । হতে পারে আমেরিকান ব্যাঙেরা ডাকে না । পৃথিবীর সব দেশের মানুষের হাসি এবং কান্না যেমন একই রকম তেমনি বৃষ্টিপাতও সে রকম। আকাশ কালো করে, বিজলি চমকিয়ে, মেঘ গর্জন করে এদেশেও মূষলধারে বৃষ্টি হয় । কখনো কখনো টানা দুই এক সপ্তাহ বৃষ্টিপাত ।
আবহাওয়ার বিষয়ে আমেরিকানরা বেশ সাবধান । প্রতিটি টিভি চ্যানেলেই কিছুক্ষণ পর পর আবাহাওয়ার রিপোর্ট দেখানো হয় । ওয়েদার চ্যানেল নামে একটি চ্যানেল আছে । যে চ্যানেলে শুধু আবহাওয়ার রিপোর্ট, আলোচনা, সমালোচনা দেখানো হয় । টানা কয়েক দিন বৃষ্টিপাতের সময় অনেক আমেরিকানকে বিরক্ত হয়ে বলতে শুনেছি, ফাকিং ওয়েদার ।
প্রচুর বৃষ্টিপাতের সময় এদেশেও অনেক বন্যা হয় । কয়েক মাস আগে টানা বৃষ্টিপাতের ফলে ওকলাহামা সিটিতে বন্যা হয় । তাড়াহুড়া করে জনসাধারণ নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেলেও কিছু পোষা প্রাণী বন্যার পানিতে আটকা পড়ে যায় । কুকুর, বেড়াল এবং কিছু পাখি । পানিতে ডুবে যায়নি এমন উচু জায়গায়, বাড়ির ছাদের ওপর, সিঁড়িতে প্রাণীগুলো অসহায়ের মতো বসে আছে সাহায্যের আশায় । টিভিতে তা দেখাচ্ছে । এই প্রাণীদের বাঁচাতে সরকারি বেসরকারি সংগঠনগুলোর সে কি তৎপরতা ! রেসকিউ টিম বা উদ্ধারকারী দল হেলিকপ্টার, স্পিডবোট নিয়ে হাজির হয়েছে । আদর করে যখন প্রাণীদেরকে স্পিডবোট ও হেলিকপ্টারে উঠাচ্ছে-টিভিতে এসব দেখে ভালোই লাগে । দেশের সঙ্গে তুলনা করলে মনটা বিষন্ন হয়ে ওঠে । বিদেশে কুকুর বেড়ালের জন্য মানুষের যে ভালোবাসা তা আমাদের দেশে মানুষের জন্যও মানুষের নেই । দৈনিক সংবাদ একবার বন্যা দুর্গত এলাকার ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে লিড নিউজ করেছিল। যার শিরোণাম ছিল, “ফটু তোলা শ্যাষ-রিলিফ দেয়া শ্যাষ।” আমাদের নেতা নেত্রীরা ফটো তোলার জন্যই রিলিফ দেন ।
নিউ ইয়র্কে বৃষ্টির রূপ একটু অন্য রকম । আকাশে যখন কালো মেঘ জমে তখন আকাশছোয়া বিল্ডিংগুলোর মাথা দেখা যায় না । মেঘে ঢাকা পড়ে যায় । বৃষ্টির সময় নিউ ইয়র্কে বেশ কিছু গালিও শোনা যায় । বাংলাদেশের রিকশার মতোই বৃষ্টির সময় এখানে ট্যাক্সি পাওয়া এক বিরাট যন্ত্রণা । হাজার হাজার হলুদ রঙের ট্যাক্সি রাস্তায় চলছে । কিন্তু TAXI লেখা নিয়ন বাতিটি জ্বলে নেই। অর্থাৎ ট্যাক্সি খালি নেই । ভেতরে যাত্রী আছে । বৃষ্টির সময় যাত্রীরা ট্যাক্সি না পেয়ে বিরক্ত হয়ে বিভিন্ন ধরনের গালি দেয় । ফাক দিস ওয়েদার, ফাকিং রেইনিং, বুলশিট, ফাক দি ট্যাক্সি, ফাকিং প্যাসেঞ্জার । আরো কতো বিচিত্র গালি !
আরেকটা জিনিস চোখে পড়ার মতো, তা হচ্ছে ছাতা । ক্ষুদে ষ্ট্রিট ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন রঙের ও ধরনের লেডিস জেন্টস ছাতা সাজিয়ে বসেন । পাঁচ ডলার, সাত ডলার ও দশ ডলার দামের এসব ছাতা নিমিষেই শেষ হয়ে যায় । যেহেতু এখানে মানুষের ইনকাম বা রোজগার বেশি তাই বৃষ্টির সময় অল্প কিছুক্ষণ ব্যবহার করার জন্যেও অনেকে ছাতা কেনেন । বৃষ্টি থামলে আবার তা গারবেজে ফেলে দেন । যাদের প্রয়োজন তারা আবার কুড়িয়ে নেয় । বৃষ্টির সময় নিউ ইয়র্ক সিটিতে অর্থাৎ ম্যানহাটানে মানুষের মাথা না দেখে শুধু ছাতা দেখা যায় ।
ওই যে সৌদি আরব থেকে দেশে গিয়ে গ্রামের এক ভদ্রলোক বলেছিলেন, মক্কা-মদিনার দেশেই আল্লাহতায়ালা সব দিয়েছেন । এতো গরমের দেশে দুইশ মাইল রাস্তা গাড়িতে গেলাম, এক ফোঁটাও গরম লাগেনি । ঠান্ডা ঠান্ডা একটা ভাব । সৌদি আরবের রাস্তাগুলোও এয়ারকন্ডিশনড । সবই আল্লাহর দান । ভদ্রলোক বুঝতে পারেননি, রাস্তা নয় গাড়িটিই ছিল এয়ারকন্ডিশনড ।
আমিও দেশে এসে যখন বর্ষা বা বৃষ্টি নিয়ে বিদেশের গল্প করবো তখন হয়তো বলবো, বৃষ্টির সময় নিউ ইয়র্কে কোনো মানুষ দেখা যায় না । শুধু ছাতা আর ছাতা । আমব্রেলা । কোটি কোটি ছাতা ।
(করিম চৌধুরী)
karimcbd@gmail.com
১০.০৮.১৯৯৯
নিউ ইয়র্ক
করিম চৌধুরী
ছাত্র জীবনে বর্ষা নামের একটি প্রবন্ধ আমাদের পাঠ্য ছিল । লেখক প্রমথ চৌধুরী । লেখকের নামটি লিখতে এবং বলতে প্রায়ই ভুল করতাম । আমি বলতাম প্রথম চৌধুরী । সহপাঠীদের ইয়ার্কি আর স্যারদের তিরষ্কার এ জন্য কম সহ্য করতে হয়নি । সহপাঠীরা কিছু দিন আমাকে প্রথম চৌধুরী বলেও ডেকেছিলো ।
চার বছর আগে ইউরোপ থেকে দেশে গিয়েছিলাম বেড়াতে । গ্রামের বাড়ীতে কয়েকদিন ছিলাম । এক দুপুরে ঝম ঝম শব্দে বৃষ্টি নামলো । কিছুক্ষণের মধ্যেই রোদ বৃষ্টি শুরু । শর্টস পরে দৌঁড়ে পুকুর পাড়ে এসে দাঁড়ালাম । অনেকক্ষণ ভিজে যখন শীত শীত লাগছিলো তখন ঘরে এসে শরীর মুছছি, এমন সময় আমার প্রয়াত প্রিয় মা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, বাড়ির সবাই বলাবলি করছে, তুই নাকি বিদেশে থেকে পাগল হয়ে গেছিস । কোনো সুস্থ মানুষ বিনা প্রয়োজনে এভাবে বৃষ্টিতে ভেজে ? আমার কাছে ছোট হলেও অন্যদের চোখে তুই বড় হয়েছিস । এখনো কেন হাফপ্যান্ট পরিস ? তুই কি ফুটবল খেলোয়াড় ?
মাকে রাগানোর জন্য আমি বললাম-মা, গরমের দিন হাফপ্যান্ট পড়তে বেশ মজা । বিদেশে তোমার মতো বৃদ্ধারাও হাফপ্যান্ট পরে ঘুরে বেড়ায় । আমাদের দেশে তো তুমি হাফপ্যান্ট পরে ঘুরতে পারবে না । আমার বেশ কয়েকটি হাফপ্যান্ট আছে । রাতে তুমি একটা হাফপ্যান্ট পরে ঘুমিয়ে দেখো কি মজা ! মা অবাক হয়ে বললেন-তওবা তওবা, নাউজুবিল্লাহ ! তুই এ সব কি বলিস ? এখন তো বাড়ির মানুষের মতো আমারো সন্দেহ হইতেছে। তোর মাথা ঠিক আছে?
টাওয়েল দিয়ে শরীর মুছতে মুছতে মা আমার চুল টেনে আদর করে বললেন,আমার পেটে যে এমন বান্দর হইবো তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।
মনে আছে ছোট বেলার কথা । ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে শিলাবৃষ্টির সময় কাঁচা আম ঝরে পড়তো । ঝড়বৃষ্টির পর প্রকৃতি শান্ত হলেও আমরা অবুঝ বালকরা হতাম অশান্ত । ব্যাগ নিয়ে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে আম কুড়োতাম । সমবয়সীদের সঙ্গে কখনো কখনো আম নিয়ে কাড়াকাড়ি থেকে মারামারি পর্যন্ত হতো । সারা শরীর কাদায় কাদাময় ।
বোন, ভাবীরা আমের ভর্তা বানিয়ে নিজেরা বেশিটুকু রেখে আমাদেরকে সামান্য দিতেন । বেশির জন্য কান্নাকাটি করেও কোনো লাভ হয়নি । ধমকের সুরে উপদেশ দিয়ে বলতেন, ছেলেদের বেশি টক খাওয়া ভালো না ।
আর ছিল চুরি। এটা তো মাষ্ট। বেশ কয়েক ঘন্টা বৃষ্টির পর আমরা বেরিয়ে পড়তাম মাছ চুরির অভিযানে । পুকুর, ডোবা ও ক্ষেতের অতিরিক্ত পানি যেখান দিয়ে বের হয়ে যেতো সেখানে পানির স্রোতের উলটো দিকে উঠে আসতো বিভিন্ন রকমের মাছ । কৈ, শিং, মাগুর, টাকি, টেংরা, শোল কখনো কখনো বোয়াল মাছও পাওয়া যেতো । কৈ মাছ তো কান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাঙায় চলে আসতো । চুরি এই জন্য যে, ওই সব পুকুর, ডোবা ও ক্ষেতের মালিক ছাড়া অন্য কেউ এই মাছ ধরতে পারবে না বলে অলিখিত নিয়ম ছিল । কিন্তু দূরন্ত বালকদের কে রুখে ? শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসের ইন্দ্রনাথকেও আমরা হারিয়ে দিতাম ।
এতোসব মধুর স্মৃতির সব কিছুকেই ম্লান করে দিয়েছিল বর্ষা বা বৃষ্টি নামের দৈত্য এক মহা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ১৯৮৮ সালে । সেই করুণ, মর্মস্পর্শী আর হৃদয়বিদারক স্মৃতি আজো মন থেকে মুছে যায়নি । বৃষ্টির পানি জমে ঢাকা ইউনিভার্সিটির জগন্নাথ হলের ছাদ ধসে সম্ভাবনাময় এতো অধিক সংখ্যক ছাত্রের এক সঙ্গে মৃত্যু দেশের ইতিহাসে আজো প্রথম । আজো চোখের সামনে ভেসে উঠে সেই বীভৎস ছবি । দেশ হারিয়ে ছিল অনেক সম্ভাবনাময় নাগরিককে । বাবা মা হারিয়ে ছিলেন ইউনির্ভার্সিটিতে পড়ুয়া তরতাজা সন্তানকে । শিক্ষক হারিয়ে ছিলেন প্রিয় ছাত্রদেরকে । প্রেমিকা হারিয়েছিলো তার প্রেমিককে । আমরা হারিয়ে ছিলাম সহপাঠী বন্ধুকে ।
আশ্চর্যের বিষয় হলো-এই মর্মান্তিক ঘটনার সময়ও কিছু রাজনীতিবিদ ব্যস্ত ছিলেন সামরিক প্রেসিডেন্ট এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ইস্যু তৈরি নিয়ে । সেদিন জেনারেল এরশাদ বাহামার রাজধানী নাসাউ-এ ছিলেন । সেখান থেকে জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে তার নিউ ইয়র্ক আসার কথা ছিল । খুব সম্ভব বিরোধী রাজনীতিকদের ইস্যু থেকে বঞ্চিত করার জন্য তিনি নিউ ইয়র্ক না এসে তড়িঘড়ি করে দেশে ফিরে যান ।
জগন্নাথ হলের প্রায় সব ছাত্রই ছিল হিন্দু ধর্মের । সেটাতেও রাজনীতিবিদরা সাম্প্রদায়িক রঙ মাখাতে চেয়েছিলেন ।
গত বছর নিউ ইয়র্কে বইমেলা উপলক্ষে দেশের জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, টিনের চালে ঝম ঝম করে বৃষ্টি পড়ার শব্দ আর ব্যাঙের ডাক শুনতে আমেরিকা ছেড়ে বাংলাদেশে চলে গেছি । আমেরিকাতেও প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় । যদিও আমাদের মতো বর্ষা ঋতু তাদের নেই । টিনের চালে বৃষ্টির ঝম ঝম শব্দ আর ব্যাঙের ডাক এখানে শুনতে পাইনি । কারণ এখানে টিনের ঘর নেই । ব্যাঙ থাকলেও ব্যাঙের ডাক কখনো শুনিনি । হতে পারে আমেরিকান ব্যাঙেরা ডাকে না । পৃথিবীর সব দেশের মানুষের হাসি এবং কান্না যেমন একই রকম তেমনি বৃষ্টিপাতও সে রকম। আকাশ কালো করে, বিজলি চমকিয়ে, মেঘ গর্জন করে এদেশেও মূষলধারে বৃষ্টি হয় । কখনো কখনো টানা দুই এক সপ্তাহ বৃষ্টিপাত ।
আবহাওয়ার বিষয়ে আমেরিকানরা বেশ সাবধান । প্রতিটি টিভি চ্যানেলেই কিছুক্ষণ পর পর আবাহাওয়ার রিপোর্ট দেখানো হয় । ওয়েদার চ্যানেল নামে একটি চ্যানেল আছে । যে চ্যানেলে শুধু আবহাওয়ার রিপোর্ট, আলোচনা, সমালোচনা দেখানো হয় । টানা কয়েক দিন বৃষ্টিপাতের সময় অনেক আমেরিকানকে বিরক্ত হয়ে বলতে শুনেছি, ফাকিং ওয়েদার ।
প্রচুর বৃষ্টিপাতের সময় এদেশেও অনেক বন্যা হয় । কয়েক মাস আগে টানা বৃষ্টিপাতের ফলে ওকলাহামা সিটিতে বন্যা হয় । তাড়াহুড়া করে জনসাধারণ নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেলেও কিছু পোষা প্রাণী বন্যার পানিতে আটকা পড়ে যায় । কুকুর, বেড়াল এবং কিছু পাখি । পানিতে ডুবে যায়নি এমন উচু জায়গায়, বাড়ির ছাদের ওপর, সিঁড়িতে প্রাণীগুলো অসহায়ের মতো বসে আছে সাহায্যের আশায় । টিভিতে তা দেখাচ্ছে । এই প্রাণীদের বাঁচাতে সরকারি বেসরকারি সংগঠনগুলোর সে কি তৎপরতা ! রেসকিউ টিম বা উদ্ধারকারী দল হেলিকপ্টার, স্পিডবোট নিয়ে হাজির হয়েছে । আদর করে যখন প্রাণীদেরকে স্পিডবোট ও হেলিকপ্টারে উঠাচ্ছে-টিভিতে এসব দেখে ভালোই লাগে । দেশের সঙ্গে তুলনা করলে মনটা বিষন্ন হয়ে ওঠে । বিদেশে কুকুর বেড়ালের জন্য মানুষের যে ভালোবাসা তা আমাদের দেশে মানুষের জন্যও মানুষের নেই । দৈনিক সংবাদ একবার বন্যা দুর্গত এলাকার ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে লিড নিউজ করেছিল। যার শিরোণাম ছিল, “ফটু তোলা শ্যাষ-রিলিফ দেয়া শ্যাষ।” আমাদের নেতা নেত্রীরা ফটো তোলার জন্যই রিলিফ দেন ।
নিউ ইয়র্কে বৃষ্টির রূপ একটু অন্য রকম । আকাশে যখন কালো মেঘ জমে তখন আকাশছোয়া বিল্ডিংগুলোর মাথা দেখা যায় না । মেঘে ঢাকা পড়ে যায় । বৃষ্টির সময় নিউ ইয়র্কে বেশ কিছু গালিও শোনা যায় । বাংলাদেশের রিকশার মতোই বৃষ্টির সময় এখানে ট্যাক্সি পাওয়া এক বিরাট যন্ত্রণা । হাজার হাজার হলুদ রঙের ট্যাক্সি রাস্তায় চলছে । কিন্তু TAXI লেখা নিয়ন বাতিটি জ্বলে নেই। অর্থাৎ ট্যাক্সি খালি নেই । ভেতরে যাত্রী আছে । বৃষ্টির সময় যাত্রীরা ট্যাক্সি না পেয়ে বিরক্ত হয়ে বিভিন্ন ধরনের গালি দেয় । ফাক দিস ওয়েদার, ফাকিং রেইনিং, বুলশিট, ফাক দি ট্যাক্সি, ফাকিং প্যাসেঞ্জার । আরো কতো বিচিত্র গালি !
আরেকটা জিনিস চোখে পড়ার মতো, তা হচ্ছে ছাতা । ক্ষুদে ষ্ট্রিট ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন রঙের ও ধরনের লেডিস জেন্টস ছাতা সাজিয়ে বসেন । পাঁচ ডলার, সাত ডলার ও দশ ডলার দামের এসব ছাতা নিমিষেই শেষ হয়ে যায় । যেহেতু এখানে মানুষের ইনকাম বা রোজগার বেশি তাই বৃষ্টির সময় অল্প কিছুক্ষণ ব্যবহার করার জন্যেও অনেকে ছাতা কেনেন । বৃষ্টি থামলে আবার তা গারবেজে ফেলে দেন । যাদের প্রয়োজন তারা আবার কুড়িয়ে নেয় । বৃষ্টির সময় নিউ ইয়র্ক সিটিতে অর্থাৎ ম্যানহাটানে মানুষের মাথা না দেখে শুধু ছাতা দেখা যায় ।
ওই যে সৌদি আরব থেকে দেশে গিয়ে গ্রামের এক ভদ্রলোক বলেছিলেন, মক্কা-মদিনার দেশেই আল্লাহতায়ালা সব দিয়েছেন । এতো গরমের দেশে দুইশ মাইল রাস্তা গাড়িতে গেলাম, এক ফোঁটাও গরম লাগেনি । ঠান্ডা ঠান্ডা একটা ভাব । সৌদি আরবের রাস্তাগুলোও এয়ারকন্ডিশনড । সবই আল্লাহর দান । ভদ্রলোক বুঝতে পারেননি, রাস্তা নয় গাড়িটিই ছিল এয়ারকন্ডিশনড ।
আমিও দেশে এসে যখন বর্ষা বা বৃষ্টি নিয়ে বিদেশের গল্প করবো তখন হয়তো বলবো, বৃষ্টির সময় নিউ ইয়র্কে কোনো মানুষ দেখা যায় না । শুধু ছাতা আর ছাতা । আমব্রেলা । কোটি কোটি ছাতা ।
(করিম চৌধুরী)
karimcbd@gmail.com
১০.০৮.১৯৯৯
নিউ ইয়র্ক
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন