সাইকেলের টায়ার ফুটো করা অথবা
মন্ত্রীদের ৭৫ হাজার টাকার মোবাইল ফোন
মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও সচিবদেরকে বিনামূল্যে ৭৫ হাজার টাকায় মোবাইল ফোন দেয়ার প্রস্তাবে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এই নিয়ে ফেসবুকে সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন যে তাঁদের দেয়া করের অর্থ এইভাবে অপচয় হচ্ছে সেটা অগ্রহণযোগ্য; কেউ কেউ এই নিয়ে হাসি-ঠাট্টাও করছেন। এই আলোচনা এবং প্রশ্নগুলো আপাতদৃষ্টে বেশ ইতিবাচক, বাংলাদেশের নাগরিকদের একাংশ সরকারকে জবাবদিহির মুখোমুখি করতে চাইছেন। কিন্ত যারা এই নিয়ে এত মন্তব্য করছেন আসলেই কী তাঁরা সরকারের জবাবদিহির প্রশ্নটিকে গুরুত্ব দেন? ধরুন এই যে সিদ্ধান্ত তার জন্যে কত ব্যয় হবে? ৯৮ লাখ ২৫ হাজার টাকা। মাত্র ৯৮ লাখ ২৫ হাজার টাকা। এই ফোনগুলোর জন্যে যতদিন ধরে বিল দেয়া হবে তার পরিমাণ কত হবে? কেউ একটা হিসেব করতে পারেন। কিন্ত প্রায় একই সময়ে আরেকটা খবর বেরিয়েছে, ‘অস্ট্রেলিয়ার তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি সান্তোসকে ২৩০ কোটি টাকা লুটে নেওয়ার অভিনব এক সুযোগ করে দিয়েছে সরকারের জ্বালানি বিভাগ। এর মধ্যে ১২৯ কোটি টাকা নিয়ে গেছে সান্তোস। বাকি ১০১ কোটি টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।‘ শুধু তাই নয়, সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে ‘দেশের সাগরবক্ষের ১৬ নম্বর ব্লকের মগনামা-২-এ গ্যাস পাওয়া যাবে না জেনেও সান্তোসের সঙ্গে যৌথভাবে বাপেক্সকে গ্যাস উত্তোলনের অনুমতি দিয়েছিল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি বিভাগ। অথচ কথিত কূপ খননের মাত্র ১৩ দিনের মাথায় সান্তোস জানিয়ে দেয়, সেখানে কোনো গ্যাসই নেই।’ জ্বালানী খাতের এটা হচ্ছে একেবারে এই সপ্তাহের ঘটনা, আগের দিনগুলোর হিসেব আপনারা নিজেরাই নিতে পারেন। ব্যাংকিং খাতের অবস্থা এমন যে সেখানে কার্যত যা হচ্ছে তাঁকে ‘ফুটো চৌবাচ্চায় জনগণের অর্থ ঢালা’ ছাড়া অন্য কোনো ভাবে বর্ণনা করা যায় না। ২০১১ সাল থেকে ২০১৭ সালের জুন মাস পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকায় দাড়িয়েছে। এর মধ্যে ৪৫ হাজার কোটি টাকা আর কোনো দিন ফেরত পাওয়ার আশাই নেই, কঠিন ভাষায় এগুলোকে বলা হয়, ‘অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণ’। আসলে কি ঘটছে তাও আমাদের কারো অজ্ঞাত থাকার কথা নয়। ‘২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে সরকারি-বেসরকারি মোট নয়টি ব্যাংকের মূলধন-ঘাটতির পরিমাণ ১৯ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। তাই পুনঃ মূলধনের নামে এ ব্যাংকগুলোকে ২০১২-১৩ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট ১৪ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা জোগান দিতে হয়েছে । এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের বাজেটেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর জন্য দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে’। এইসব তথ্য উল্লেখা করে রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ‘করের টাকা দিয়ে বিসমিল্লাহ, হল-মার্ক, এননটেক্সসহ অন্যান্য ব্যাংক লুটকারীর ভরণপোষণ করা হচ্ছে’। এই রকম হিসেবের তো শেষ নেই।
এই যে এইসব ‘অপচয়’, কিংবা লুটপাট তার জন্যে সরকারের জবাবদিহি দাবি না করে টেলিফোনের হিসেব নিয়ে যারা উদ্বিগ্ন তাঁদের বক্তব্যের সারমর্ম বুঝতে অপারগ। আমি এমনকি এক টাকার জন্যেও জবাবদিহির পক্ষে; কিন্ত বড় ধরণের লুটপাটের বিষয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ব্যবস্থার পক্ষে দাঁড়িয়ে একটি ঘটনায় যারা একেবারে মারমুখি হয়ে উঠেছেন তাঁদের আচরণের বিষয়টি আমাকে বিস্মিত করে। তারচেয়েও বড় কথা হচ্ছে যেখানে গোটা শাসন ব্যবস্থাটাই জবাবদিহির উর্ধে তুলে দেয়া হয়েছে ২০১৪ সালের ‘নির্বাচনের’ মাধ্যমে সেখানে আমরা কি করে আশা করতে পারি যে, টেলিফোন কেনায় জবাবদিহি থাকবে? শাসনের ভিত্তির মধ্যে অনুপস্থিত জবাবদিহিতা নিয়ে প্রশ্ন না করে তাকে সারাক্ষন যারা সমর্থন করে যাচ্ছেন, এই নিয়ে প্রশ্ন তুললে বিভিন্ন লেবেল সেটে দিচ্ছেন তারাই যখন এই ফোন বিষয়ে বেশ উচ্চকণ্ঠ হন তখন আমার যে কৌতুকটা মনে পড়ে সেটা আপনাদের জানা। আমি আগেও লিখেছি।
২০০৩ সালে প্রেসিডেন্ট বুশ তার সভাসদদের নিয়ে বসেছেন। তাঁদের বললেন 'আমি ঠিক করেছি গোটা ইরাক বোমা মেরে ধ্বংস করে দেবো, আর বাগদাদের সবচেয়ে বড় রাস্তায় নিয়ে একটা সাইকেলের টায়ার ফুটো করে দেবো।' সবাই জিজ্ঞেস করলো 'সাইকেলের টায়ার ফুটো করবেন কেন?' বুশ হেসে বলল 'দেখুন আমি ইরাক ধ্বংস করবো সেটা নিয়ে প্রশ্ন করছেন না, আপনারা জিজ্ঞেস করছেন কেন সাইকেলের টায়ার ফুটো করবো। ঠিক এই কারনেই আমি সাইকেলের টায়ার ফুটো করবো।' অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে অনেকেই সাইকেলের টায়ার ফুটো করার গল্পে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
এক টাকার জবাবদিহিও চাওয়া দরকার, কিন্ত কেবল এক টাকার জবাবদিহি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন না যেন।
Courtesy: Ali Riaz
Head of the Department of
Government & Politics
Illinois State University
U.S.A.
মন্ত্রীদের ৭৫ হাজার টাকার মোবাইল ফোন
মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও সচিবদেরকে বিনামূল্যে ৭৫ হাজার টাকায় মোবাইল ফোন দেয়ার প্রস্তাবে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এই নিয়ে ফেসবুকে সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন যে তাঁদের দেয়া করের অর্থ এইভাবে অপচয় হচ্ছে সেটা অগ্রহণযোগ্য; কেউ কেউ এই নিয়ে হাসি-ঠাট্টাও করছেন। এই আলোচনা এবং প্রশ্নগুলো আপাতদৃষ্টে বেশ ইতিবাচক, বাংলাদেশের নাগরিকদের একাংশ সরকারকে জবাবদিহির মুখোমুখি করতে চাইছেন। কিন্ত যারা এই নিয়ে এত মন্তব্য করছেন আসলেই কী তাঁরা সরকারের জবাবদিহির প্রশ্নটিকে গুরুত্ব দেন? ধরুন এই যে সিদ্ধান্ত তার জন্যে কত ব্যয় হবে? ৯৮ লাখ ২৫ হাজার টাকা। মাত্র ৯৮ লাখ ২৫ হাজার টাকা। এই ফোনগুলোর জন্যে যতদিন ধরে বিল দেয়া হবে তার পরিমাণ কত হবে? কেউ একটা হিসেব করতে পারেন। কিন্ত প্রায় একই সময়ে আরেকটা খবর বেরিয়েছে, ‘অস্ট্রেলিয়ার তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি সান্তোসকে ২৩০ কোটি টাকা লুটে নেওয়ার অভিনব এক সুযোগ করে দিয়েছে সরকারের জ্বালানি বিভাগ। এর মধ্যে ১২৯ কোটি টাকা নিয়ে গেছে সান্তোস। বাকি ১০১ কোটি টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।‘ শুধু তাই নয়, সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে ‘দেশের সাগরবক্ষের ১৬ নম্বর ব্লকের মগনামা-২-এ গ্যাস পাওয়া যাবে না জেনেও সান্তোসের সঙ্গে যৌথভাবে বাপেক্সকে গ্যাস উত্তোলনের অনুমতি দিয়েছিল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি বিভাগ। অথচ কথিত কূপ খননের মাত্র ১৩ দিনের মাথায় সান্তোস জানিয়ে দেয়, সেখানে কোনো গ্যাসই নেই।’ জ্বালানী খাতের এটা হচ্ছে একেবারে এই সপ্তাহের ঘটনা, আগের দিনগুলোর হিসেব আপনারা নিজেরাই নিতে পারেন। ব্যাংকিং খাতের অবস্থা এমন যে সেখানে কার্যত যা হচ্ছে তাঁকে ‘ফুটো চৌবাচ্চায় জনগণের অর্থ ঢালা’ ছাড়া অন্য কোনো ভাবে বর্ণনা করা যায় না। ২০১১ সাল থেকে ২০১৭ সালের জুন মাস পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকায় দাড়িয়েছে। এর মধ্যে ৪৫ হাজার কোটি টাকা আর কোনো দিন ফেরত পাওয়ার আশাই নেই, কঠিন ভাষায় এগুলোকে বলা হয়, ‘অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণ’। আসলে কি ঘটছে তাও আমাদের কারো অজ্ঞাত থাকার কথা নয়। ‘২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে সরকারি-বেসরকারি মোট নয়টি ব্যাংকের মূলধন-ঘাটতির পরিমাণ ১৯ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। তাই পুনঃ মূলধনের নামে এ ব্যাংকগুলোকে ২০১২-১৩ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট ১৪ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা জোগান দিতে হয়েছে । এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের বাজেটেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর জন্য দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে’। এইসব তথ্য উল্লেখা করে রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ‘করের টাকা দিয়ে বিসমিল্লাহ, হল-মার্ক, এননটেক্সসহ অন্যান্য ব্যাংক লুটকারীর ভরণপোষণ করা হচ্ছে’। এই রকম হিসেবের তো শেষ নেই।
এই যে এইসব ‘অপচয়’, কিংবা লুটপাট তার জন্যে সরকারের জবাবদিহি দাবি না করে টেলিফোনের হিসেব নিয়ে যারা উদ্বিগ্ন তাঁদের বক্তব্যের সারমর্ম বুঝতে অপারগ। আমি এমনকি এক টাকার জন্যেও জবাবদিহির পক্ষে; কিন্ত বড় ধরণের লুটপাটের বিষয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ব্যবস্থার পক্ষে দাঁড়িয়ে একটি ঘটনায় যারা একেবারে মারমুখি হয়ে উঠেছেন তাঁদের আচরণের বিষয়টি আমাকে বিস্মিত করে। তারচেয়েও বড় কথা হচ্ছে যেখানে গোটা শাসন ব্যবস্থাটাই জবাবদিহির উর্ধে তুলে দেয়া হয়েছে ২০১৪ সালের ‘নির্বাচনের’ মাধ্যমে সেখানে আমরা কি করে আশা করতে পারি যে, টেলিফোন কেনায় জবাবদিহি থাকবে? শাসনের ভিত্তির মধ্যে অনুপস্থিত জবাবদিহিতা নিয়ে প্রশ্ন না করে তাকে সারাক্ষন যারা সমর্থন করে যাচ্ছেন, এই নিয়ে প্রশ্ন তুললে বিভিন্ন লেবেল সেটে দিচ্ছেন তারাই যখন এই ফোন বিষয়ে বেশ উচ্চকণ্ঠ হন তখন আমার যে কৌতুকটা মনে পড়ে সেটা আপনাদের জানা। আমি আগেও লিখেছি।
২০০৩ সালে প্রেসিডেন্ট বুশ তার সভাসদদের নিয়ে বসেছেন। তাঁদের বললেন 'আমি ঠিক করেছি গোটা ইরাক বোমা মেরে ধ্বংস করে দেবো, আর বাগদাদের সবচেয়ে বড় রাস্তায় নিয়ে একটা সাইকেলের টায়ার ফুটো করে দেবো।' সবাই জিজ্ঞেস করলো 'সাইকেলের টায়ার ফুটো করবেন কেন?' বুশ হেসে বলল 'দেখুন আমি ইরাক ধ্বংস করবো সেটা নিয়ে প্রশ্ন করছেন না, আপনারা জিজ্ঞেস করছেন কেন সাইকেলের টায়ার ফুটো করবো। ঠিক এই কারনেই আমি সাইকেলের টায়ার ফুটো করবো।' অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে অনেকেই সাইকেলের টায়ার ফুটো করার গল্পে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
এক টাকার জবাবদিহিও চাওয়া দরকার, কিন্ত কেবল এক টাকার জবাবদিহি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন না যেন।
Courtesy: Ali Riaz
Head of the Department of
Government & Politics
Illinois State University
U.S.A.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন