ভাষা আন্দোলন ও গণমাধ্যম
করিম চৌধুরী
ভাষা, সংস্কৃতি, আচার, ঐতিহ্যই যে জাতিসত্ত্বার প্রকৃত উপাদান তা বাঙালীই ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে প্রমাণ করে। ভাষা আন্দোলন তাই শুধু একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সীমাবদ্ধ ছিলো না। মূলত: এটা ছিলো একটি জাতিসত্ত্বা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।
পৃথিবীতে মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে একমাত্র বাঙালীরাই প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন সেই ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে। তাই একুশে ফেব্রুয়ারির ঐতিহ্য এক মহান সংগ্রামী ঐতিহ্য। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনায় গণমাধ্যমের ভূমিকা কি ছিল তা আলোচনা করতে গেলে তারও পেছনে ফিরে তাঁকাতে হবে। মনে রাখতে হবে, গণমাধ্যম বলতে এক্ষেত্রে শুধু পত্র পত্রিকা ও পুস্তিকা বুঝানো হচ্ছে। কেননা তখনো এদেশে টেলিভিশন নেটওয়ার্ক ছিলো না। টেলিভিশন আসে ১৯৬৪ সালে। রেডিও ছিলো সরকার নিয়ন্ত্রিত।
দেশ বিভাগের আগেই ১৯৪৭ সালের ১৭ মে দাক্ষিণাত্যের হায়দ্রাবাদে অনুষ্ঠিত উর্দু সম্মেলনে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির অন্যতম সদস্য এবং পরে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর চৌধুরী খালেকুজ্জামান ঘোষণা করলেন যে,
উর্দুই হবে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা ।
১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে ভারতের আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ বললেন,
উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহন করা উচিৎ।
জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ১৯৪৭ সালের ২৯ জুলাই স্ব-নামে ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায়
পাকিস্তানের ভাষা সমস্যা” শিরোণামে নিবন্ধ লিখলেন। ড. শহীদুল্লাহ পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে বাংলার দাবীকে অগ্রগণ্য উল্লেখ করে লিখেছিলেন,
যদি এরপরেও অন্য কোন ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রশ্ন আসে, শুধু তা হলেই উর্দুর কথা চিন্তা করা যেতে পারে।
অ্যাডভোকেট গাজীউল হকের মতে ‘ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর এ বক্তব্য তখন এদেশের শিক্ষিত এবং বুদ্ধিজীবী মহলে ভাষা সম্পর্কে প্রথম আলোড়ন সৃষ্টি করে।’ অধ্যাপক আবুল কাশেমের সম্পাদনায় ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিশের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু ? এই শিরোণামে একটা পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। বিশিষ্ট সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও সোহরাওয়ার্দী সমর্থক রাজনীতিবিদ জনাব আবুল মনসুর আহমদ এবং মুক্তবুদ্ধি সম্পন্ন চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবি ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন এই পুস্তিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে রাষ্ট্র ভাষা বাংলার স্বপক্ষে জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন।
১৯৪৭ সালের ১২ ডিসেম্বর ঢাকায় উর্দু ও বাংলা ভাষার সমর্থকদের মধ্যে মারাত্মক সংঘর্ষ হয়। তখন কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদে এ সম্পর্কিত সংবাদ শিরোণামটি ছিল নিম্নরূপঢাকায় বাংলা ও উর্দু ভাষা
সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ
রাষ্ট্র ভাষা উর্দু দাবী করিয়া প্রচার করার জের
২০ জনেরও অধিক ব্যক্তি আহত ।
এই প্রেক্ষাপটে জ্ঞানতাপস ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা সমস্যা নামে আরেকটা প্রবন্ধ লেখেন। ১৯৪৭ সালের ২১ ডিসেম্বর দৈনিক আজাদে প্রকাশিত ওই প্রবন্ধে ড. শহীদুল্লাহ লিখলেন,
যাঁহারা বাংলাদেশে বাংলা ভাষাকে ছাড়িয়া কিংবা বাংলার স্কুল-কলেজে শিক্ষার মাধ্যম (মিডিয়াম) রূপে অথবা বাংলাদেশের আইন আদালতে ব্যবহার্য ভাষারূপে উর্দুর পক্ষে ওকালতি করিতেছেন, আমি তাঁহাদিগকে কান্ডজ্ঞানবিহীন পন্ডিতমূর্খ ভিন্ন আর কিছুই মনে করিতে পারি না ।
১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ তারিখে গভর্ণর জেনারেল এম.এ. জিন্নাহর রেসকোর্স ময়দানে জনসভা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে মি. জিন্নাহ ঘোষণা করলেন যে,
Urdu, only Urdu shall be the state language of Pakistan.
ছাত্ররা তাঁর সামনেই না, না বলে চিৎকার করে প্রতিবাদ করেন। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, কথাটা তিনি বলেছিলেন ইংরেজীতে। তিনি উর্দু জানতেন না বলে জনশ্রুতি আছে । ১৯৪৮ সালের ১৪ মার্চ দৈনিক আজাদে প্রকাশিত একটি শিরোণাম ছিল...
বঙ্গভাষায় গাড়ির নাম্বার প্লেট: ড্রাইভারের ৫ টাকা জরিমানা ।
কলকাতা থেকে প্রকাশিত সোহরাওয়ার্দী সমর্থক দৈনিক পত্রিকা ‘ইত্তেহাদ’ও ওই সময় রাষ্ট্র ভাষার প্রশ্নে পূর্ববঙ্গবাসীর দাবীকে সমর্থন করে। উল্লেখ্য ১৯৪৮ সালের শেষে ‘দৈনিক আজাদ’ কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে প্রকাশনা শুরু করে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল বৃহস্পতিবার। ওই দিন ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণ ছিলো এক অভাবিত ঘটনা। স্বভাবতঃই 'দৈনিক আজাদ’ ‘সংবাদ’ ‘মিল্লাত’ ‘সাপ্তাহিক ইত্তেফাক’ ‘সৈনিক’ ‘নওবেলাল’ এমনকি ‘ইনসাফ’ ও ‘জিন্দেগী’র মতো পত্রিকাও যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে খবরগুলো ছেপেছিলো। সঙ্গে ছিলো উপসম্পাদকীয় ও মন্তব্য। দৈনিক ‘আজাদ’ তো একুশে সন্ধ্যায় গুলিবর্ষণ ও আহত-নিহতদের তালিকা এবং ঘটনাবলীসহ ‘টেলিগ্রাম সংখ্যা’ বের করে ফেলেছিলো।
হেডিং ছিল...
ঢাকার রাজপথ ছাত্রদের তাজা খুনে রঞ্জিত।
সঙ্গে সঙ্গেই ওই বিশেষ সংখ্যাটি বেআইনি ঘোষিত হয়। ‘আজাদ’ পত্রিকাটির রাজনৈতিক চরিত্র যদিও প্রশংসনীয় ছিলো না, তবু সেই উত্তাল দিনগুলোতে কয়েকটি দিন প্রাদেশিক সরকারের বিরুদ্ধ ভূমিকায় নেমে এসেছিলো। তাতে এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন ঐতিহ্যগত দিক থেকে লাভবান হয়েছে, বলাই বাহুল্য।
ওই দিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর ছিলো পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে রেডিও’র ঢাকা কেন্দ্রের শিল্পীদের বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত, যে জন্য সেদিন রেডিও’র তৃতীয় অধিবেশনে শুধু রেকর্ডকৃত গান বাজিয়ে শোনানো হয়েছিলো।
‘ইনসাফ’ ছোট পত্রিকা হলেও ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ ও বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহন করেছিলো। তা যেমন সংবাদ পরিবেশনে তেমনি সম্পাদকীয় মতামত উপস্থাপনে। এক কথায় ‘ইনসাফ’ দেশজ সংস্কৃতির স্বার্থে আন্দোলনের সঠিক চিত্র তুলে ধরেই ক্ষান্ত হয়নি, আন্দোলনের পক্ষে যুক্তি নির্ভর মতামতও প্রকাশ করেছে।
বিদেশী দৈনিক The Statesman (কলকাতা থেকে প্রকাশিত) এর সংবাদ পরিবেশনা ছিল নিরপেক্ষ এবং সম্পাদকীয়গুলো ছিল অনাবেগ ও যুক্তি নির্ভর।
২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে ষ্টেটসম্যান পত্রিকার শিরোণাম ছিল...
ঢাকায় ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণ: ভাষার প্রশ্ন নিয়ে প্রতিবাদ মিছিল: এসেম্বলিতে প্রতিবাদ ।
সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদনে সেখানে বলা হয়েছে প্রায় ১০০ ছাত্র গ্রেফতারের কথা, ১৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হবার কথা। অন্যদিকে পরিষদ ভবনের ভেতরে ঘটনাবলীর কিছুটা বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। ‘কংগ্রেস এম.এল.এ'দের ওয়াক আউট, মৌলানা তর্কবাগীশ, শামসুদ্দিন আহম্মদ ও খয়রাত হোসেনদের পরিষদ কক্ষ ত্যাগের ঘটনাও স্থান পেয়েছে। পাকিস্তানের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা অধ্যুষিত পূর্ব পাকিস্তানে বিদেশী ভাষা চাপিয়ে দেবার ঔচিত্য নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
২৩ ফেব্রুয়ারির ‘আজাদ’ সেদিন সবার হাতে হাতে ঘুরেছে। মোট মোটা হরফে আজাদের শিরোণাম ছিল...
'শুক্রবার শহরের অবস্থার আরো অবনতি: সরকার কর্তৃক সামরিক বাহিনী তলব।’
‘পুলিশ ও সৈন্যদের গুলিতে ৪ জন নিহত এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত: সাত ঘন্টার জন্য কারফিউ জারি।’
‘শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনার্থে শহরে স্বত:স্ফূর্ত হরতাল পালন।’
‘পুলিশী জুলুমের প্রতিবাদে আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীনের পরিষদ সদস্যপদে এস্তেফা ।'
‘আজদ’ সেদিন ঐতিহাসিক বাহান্নকে ঐতিহাসিক দক্ষতায় কভার করেছিলো। জেড,এ সুলেরীর ‘ইভনিং টাইমস্’ পত্রিকার পাতায়ও অনেকটা একই ধরনের চিত্র। তবে সুলেরী সাহেব নিজে ঢাকা ঘুরে যাবার ফলে এখানকার পরিস্থিতির সাথে সরেজমিনে পরিচিত হবার সুযোগ ঘটেছিলো। তাই এক বিবৃতিতে তিনি বলেন:
‘বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীর পেছনে জনগণের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। দেশাত্নবোধই এই দাবীর মুল উৎস।’
বিভিন্ন দিক থেকে বিচারে ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত The Statesman পত্রিকার সম্পাদকীয় বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন ও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ নিবন্ধটির বৈশিষ্ট্য। তাদের মতে..
গুলিবর্ষণের কাজটি শুধু দু:খজনকই নয় সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় ছিল ।
পঞ্চাশ দশকে সাময়িকীর জগতে ‘অগত্যা''র অবির্ভাত ছিলো এক বিস্ময়কর ঘটনা। পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন প্রয়াত ফজলে লোহানী, ( যিনি 'যদি কিছু না মনে করেন' বিটিভির সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ছিলেন।) প্রকাশক ছিলেন নাসিরুদ্দিন হায়দার (সবুজ)। ‘অগত্যা গোষ্ঠী’ বলে পরিচিতদের মধ্যে ছিলেন মুস্তাফা নূর উল ইসলাম, তসিকুল আলম খান, মাহবুব জামাল ও আনিস চৌধুরী।
বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর বেপোরোয়া হামলার কঠোর ভাষায় নিন্দা, করাচী-পিন্ডির তল্পিবাহকদের স্বরূপ উন্মোচনে ‘অগত্যা’র সর্বদাই অগ্রনী ভূমিকায় ছিলো। কঠোর সমালোচনামূলক তীব্র ব্যাঙ্গাত্নক রচনায় পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যাই ছিলো সোচ্চার। কিছুদিনের মধ্যেই ‘অগত্যা’ শাসককুলদের জন্যে পরিণত হলো এক বিভীষিকায়।
অবাঙালী স্বার্থের প্রতিনিধি ‘মর্নিং নিউজ’ ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে অব্যাহত ধারায় বিষোদগার করে যাচ্ছিলো। দিনের পর দিন মিথ্যা খবর, সম্পাদকীয় এবং উপসম্পাদকীয় লিখে ‘মর্নিং নিউজ’ (যার পরিচয় ছিল ভয়েস অব নেশন) বাংলা ভাষা ও বাঙালী সংস্কৃতির বিরোধী ভূমিকা পালন করেছে। ভাষা বিরোধী ভূমিকা নিয়ে ‘মর্নিং নিউজ’-এর সেই কুখ্যাত ব্যানার
ঢোটিস রোমিং ঢাকা স্ট্রিট
প্রতিটি রাজনীতি সচেতন বাঙালীর প্রচন্ড ক্ষোভের কারণ হয়ে উঠেছিলো, যে ক্ষোভ প্রকাশ পায় ২২ ফেব্রুয়ারি ‘মর্নিং নিউজ’এর ছাপাখানা জুবিলী প্রেস পোড়ানোর মধ্য দিয়ে। এতোসব ঘটনার পর ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান রচিত হলে উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও সংবিধানে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
এখন প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপিত হয়। তা শুধু আমাদের ভাষা আন্দোলনেরই গৌরবোজ্জল ফসল। এ গৌরব আর কোন জাতিরই নেই। এ গৌরব আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন।
করিম চৌধুরী
২ ফেব্রুয়ারি,২০০৫
ইমেল: karimcbd@gmail.com
লেখাটি ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দৈনিক ভোরের কাগজ-এ প্রকাশিত হয়েছিলো। আমার খুব পরিশ্রমী লেখা ছিলো এটি।
করিম চৌধুরী
ভাষা, সংস্কৃতি, আচার, ঐতিহ্যই যে জাতিসত্ত্বার প্রকৃত উপাদান তা বাঙালীই ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে প্রমাণ করে। ভাষা আন্দোলন তাই শুধু একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সীমাবদ্ধ ছিলো না। মূলত: এটা ছিলো একটি জাতিসত্ত্বা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।
পৃথিবীতে মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে একমাত্র বাঙালীরাই প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন সেই ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে। তাই একুশে ফেব্রুয়ারির ঐতিহ্য এক মহান সংগ্রামী ঐতিহ্য। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনায় গণমাধ্যমের ভূমিকা কি ছিল তা আলোচনা করতে গেলে তারও পেছনে ফিরে তাঁকাতে হবে। মনে রাখতে হবে, গণমাধ্যম বলতে এক্ষেত্রে শুধু পত্র পত্রিকা ও পুস্তিকা বুঝানো হচ্ছে। কেননা তখনো এদেশে টেলিভিশন নেটওয়ার্ক ছিলো না। টেলিভিশন আসে ১৯৬৪ সালে। রেডিও ছিলো সরকার নিয়ন্ত্রিত।
দেশ বিভাগের আগেই ১৯৪৭ সালের ১৭ মে দাক্ষিণাত্যের হায়দ্রাবাদে অনুষ্ঠিত উর্দু সম্মেলনে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির অন্যতম সদস্য এবং পরে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর চৌধুরী খালেকুজ্জামান ঘোষণা করলেন যে,
উর্দুই হবে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা ।
১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে ভারতের আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ বললেন,
উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহন করা উচিৎ।
জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ১৯৪৭ সালের ২৯ জুলাই স্ব-নামে ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায়
পাকিস্তানের ভাষা সমস্যা” শিরোণামে নিবন্ধ লিখলেন। ড. শহীদুল্লাহ পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে বাংলার দাবীকে অগ্রগণ্য উল্লেখ করে লিখেছিলেন,
যদি এরপরেও অন্য কোন ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রশ্ন আসে, শুধু তা হলেই উর্দুর কথা চিন্তা করা যেতে পারে।
অ্যাডভোকেট গাজীউল হকের মতে ‘ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর এ বক্তব্য তখন এদেশের শিক্ষিত এবং বুদ্ধিজীবী মহলে ভাষা সম্পর্কে প্রথম আলোড়ন সৃষ্টি করে।’ অধ্যাপক আবুল কাশেমের সম্পাদনায় ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিশের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু ? এই শিরোণামে একটা পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। বিশিষ্ট সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও সোহরাওয়ার্দী সমর্থক রাজনীতিবিদ জনাব আবুল মনসুর আহমদ এবং মুক্তবুদ্ধি সম্পন্ন চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবি ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন এই পুস্তিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে রাষ্ট্র ভাষা বাংলার স্বপক্ষে জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন।
১৯৪৭ সালের ১২ ডিসেম্বর ঢাকায় উর্দু ও বাংলা ভাষার সমর্থকদের মধ্যে মারাত্মক সংঘর্ষ হয়। তখন কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদে এ সম্পর্কিত সংবাদ শিরোণামটি ছিল নিম্নরূপঢাকায় বাংলা ও উর্দু ভাষা
সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ
রাষ্ট্র ভাষা উর্দু দাবী করিয়া প্রচার করার জের
২০ জনেরও অধিক ব্যক্তি আহত ।
এই প্রেক্ষাপটে জ্ঞানতাপস ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা সমস্যা নামে আরেকটা প্রবন্ধ লেখেন। ১৯৪৭ সালের ২১ ডিসেম্বর দৈনিক আজাদে প্রকাশিত ওই প্রবন্ধে ড. শহীদুল্লাহ লিখলেন,
যাঁহারা বাংলাদেশে বাংলা ভাষাকে ছাড়িয়া কিংবা বাংলার স্কুল-কলেজে শিক্ষার মাধ্যম (মিডিয়াম) রূপে অথবা বাংলাদেশের আইন আদালতে ব্যবহার্য ভাষারূপে উর্দুর পক্ষে ওকালতি করিতেছেন, আমি তাঁহাদিগকে কান্ডজ্ঞানবিহীন পন্ডিতমূর্খ ভিন্ন আর কিছুই মনে করিতে পারি না ।
১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ তারিখে গভর্ণর জেনারেল এম.এ. জিন্নাহর রেসকোর্স ময়দানে জনসভা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে মি. জিন্নাহ ঘোষণা করলেন যে,
Urdu, only Urdu shall be the state language of Pakistan.
ছাত্ররা তাঁর সামনেই না, না বলে চিৎকার করে প্রতিবাদ করেন। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, কথাটা তিনি বলেছিলেন ইংরেজীতে। তিনি উর্দু জানতেন না বলে জনশ্রুতি আছে । ১৯৪৮ সালের ১৪ মার্চ দৈনিক আজাদে প্রকাশিত একটি শিরোণাম ছিল...
বঙ্গভাষায় গাড়ির নাম্বার প্লেট: ড্রাইভারের ৫ টাকা জরিমানা ।
কলকাতা থেকে প্রকাশিত সোহরাওয়ার্দী সমর্থক দৈনিক পত্রিকা ‘ইত্তেহাদ’ও ওই সময় রাষ্ট্র ভাষার প্রশ্নে পূর্ববঙ্গবাসীর দাবীকে সমর্থন করে। উল্লেখ্য ১৯৪৮ সালের শেষে ‘দৈনিক আজাদ’ কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে প্রকাশনা শুরু করে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল বৃহস্পতিবার। ওই দিন ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণ ছিলো এক অভাবিত ঘটনা। স্বভাবতঃই 'দৈনিক আজাদ’ ‘সংবাদ’ ‘মিল্লাত’ ‘সাপ্তাহিক ইত্তেফাক’ ‘সৈনিক’ ‘নওবেলাল’ এমনকি ‘ইনসাফ’ ও ‘জিন্দেগী’র মতো পত্রিকাও যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে খবরগুলো ছেপেছিলো। সঙ্গে ছিলো উপসম্পাদকীয় ও মন্তব্য। দৈনিক ‘আজাদ’ তো একুশে সন্ধ্যায় গুলিবর্ষণ ও আহত-নিহতদের তালিকা এবং ঘটনাবলীসহ ‘টেলিগ্রাম সংখ্যা’ বের করে ফেলেছিলো।
হেডিং ছিল...
ঢাকার রাজপথ ছাত্রদের তাজা খুনে রঞ্জিত।
সঙ্গে সঙ্গেই ওই বিশেষ সংখ্যাটি বেআইনি ঘোষিত হয়। ‘আজাদ’ পত্রিকাটির রাজনৈতিক চরিত্র যদিও প্রশংসনীয় ছিলো না, তবু সেই উত্তাল দিনগুলোতে কয়েকটি দিন প্রাদেশিক সরকারের বিরুদ্ধ ভূমিকায় নেমে এসেছিলো। তাতে এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন ঐতিহ্যগত দিক থেকে লাভবান হয়েছে, বলাই বাহুল্য।
ওই দিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর ছিলো পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে রেডিও’র ঢাকা কেন্দ্রের শিল্পীদের বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত, যে জন্য সেদিন রেডিও’র তৃতীয় অধিবেশনে শুধু রেকর্ডকৃত গান বাজিয়ে শোনানো হয়েছিলো।
‘ইনসাফ’ ছোট পত্রিকা হলেও ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ ও বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহন করেছিলো। তা যেমন সংবাদ পরিবেশনে তেমনি সম্পাদকীয় মতামত উপস্থাপনে। এক কথায় ‘ইনসাফ’ দেশজ সংস্কৃতির স্বার্থে আন্দোলনের সঠিক চিত্র তুলে ধরেই ক্ষান্ত হয়নি, আন্দোলনের পক্ষে যুক্তি নির্ভর মতামতও প্রকাশ করেছে।
বিদেশী দৈনিক The Statesman (কলকাতা থেকে প্রকাশিত) এর সংবাদ পরিবেশনা ছিল নিরপেক্ষ এবং সম্পাদকীয়গুলো ছিল অনাবেগ ও যুক্তি নির্ভর।
২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে ষ্টেটসম্যান পত্রিকার শিরোণাম ছিল...
ঢাকায় ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণ: ভাষার প্রশ্ন নিয়ে প্রতিবাদ মিছিল: এসেম্বলিতে প্রতিবাদ ।
সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদনে সেখানে বলা হয়েছে প্রায় ১০০ ছাত্র গ্রেফতারের কথা, ১৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হবার কথা। অন্যদিকে পরিষদ ভবনের ভেতরে ঘটনাবলীর কিছুটা বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। ‘কংগ্রেস এম.এল.এ'দের ওয়াক আউট, মৌলানা তর্কবাগীশ, শামসুদ্দিন আহম্মদ ও খয়রাত হোসেনদের পরিষদ কক্ষ ত্যাগের ঘটনাও স্থান পেয়েছে। পাকিস্তানের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা অধ্যুষিত পূর্ব পাকিস্তানে বিদেশী ভাষা চাপিয়ে দেবার ঔচিত্য নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
২৩ ফেব্রুয়ারির ‘আজাদ’ সেদিন সবার হাতে হাতে ঘুরেছে। মোট মোটা হরফে আজাদের শিরোণাম ছিল...
'শুক্রবার শহরের অবস্থার আরো অবনতি: সরকার কর্তৃক সামরিক বাহিনী তলব।’
‘পুলিশ ও সৈন্যদের গুলিতে ৪ জন নিহত এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত: সাত ঘন্টার জন্য কারফিউ জারি।’
‘শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনার্থে শহরে স্বত:স্ফূর্ত হরতাল পালন।’
‘পুলিশী জুলুমের প্রতিবাদে আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীনের পরিষদ সদস্যপদে এস্তেফা ।'
‘আজদ’ সেদিন ঐতিহাসিক বাহান্নকে ঐতিহাসিক দক্ষতায় কভার করেছিলো। জেড,এ সুলেরীর ‘ইভনিং টাইমস্’ পত্রিকার পাতায়ও অনেকটা একই ধরনের চিত্র। তবে সুলেরী সাহেব নিজে ঢাকা ঘুরে যাবার ফলে এখানকার পরিস্থিতির সাথে সরেজমিনে পরিচিত হবার সুযোগ ঘটেছিলো। তাই এক বিবৃতিতে তিনি বলেন:
‘বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীর পেছনে জনগণের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। দেশাত্নবোধই এই দাবীর মুল উৎস।’
বিভিন্ন দিক থেকে বিচারে ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত The Statesman পত্রিকার সম্পাদকীয় বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন ও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ নিবন্ধটির বৈশিষ্ট্য। তাদের মতে..
গুলিবর্ষণের কাজটি শুধু দু:খজনকই নয় সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় ছিল ।
পঞ্চাশ দশকে সাময়িকীর জগতে ‘অগত্যা''র অবির্ভাত ছিলো এক বিস্ময়কর ঘটনা। পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন প্রয়াত ফজলে লোহানী, ( যিনি 'যদি কিছু না মনে করেন' বিটিভির সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ছিলেন।) প্রকাশক ছিলেন নাসিরুদ্দিন হায়দার (সবুজ)। ‘অগত্যা গোষ্ঠী’ বলে পরিচিতদের মধ্যে ছিলেন মুস্তাফা নূর উল ইসলাম, তসিকুল আলম খান, মাহবুব জামাল ও আনিস চৌধুরী।
বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর বেপোরোয়া হামলার কঠোর ভাষায় নিন্দা, করাচী-পিন্ডির তল্পিবাহকদের স্বরূপ উন্মোচনে ‘অগত্যা’র সর্বদাই অগ্রনী ভূমিকায় ছিলো। কঠোর সমালোচনামূলক তীব্র ব্যাঙ্গাত্নক রচনায় পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যাই ছিলো সোচ্চার। কিছুদিনের মধ্যেই ‘অগত্যা’ শাসককুলদের জন্যে পরিণত হলো এক বিভীষিকায়।
অবাঙালী স্বার্থের প্রতিনিধি ‘মর্নিং নিউজ’ ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে অব্যাহত ধারায় বিষোদগার করে যাচ্ছিলো। দিনের পর দিন মিথ্যা খবর, সম্পাদকীয় এবং উপসম্পাদকীয় লিখে ‘মর্নিং নিউজ’ (যার পরিচয় ছিল ভয়েস অব নেশন) বাংলা ভাষা ও বাঙালী সংস্কৃতির বিরোধী ভূমিকা পালন করেছে। ভাষা বিরোধী ভূমিকা নিয়ে ‘মর্নিং নিউজ’-এর সেই কুখ্যাত ব্যানার
ঢোটিস রোমিং ঢাকা স্ট্রিট
প্রতিটি রাজনীতি সচেতন বাঙালীর প্রচন্ড ক্ষোভের কারণ হয়ে উঠেছিলো, যে ক্ষোভ প্রকাশ পায় ২২ ফেব্রুয়ারি ‘মর্নিং নিউজ’এর ছাপাখানা জুবিলী প্রেস পোড়ানোর মধ্য দিয়ে। এতোসব ঘটনার পর ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান রচিত হলে উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও সংবিধানে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
এখন প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপিত হয়। তা শুধু আমাদের ভাষা আন্দোলনেরই গৌরবোজ্জল ফসল। এ গৌরব আর কোন জাতিরই নেই। এ গৌরব আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন।
করিম চৌধুরী
২ ফেব্রুয়ারি,২০০৫
ইমেল: karimcbd@gmail.com
লেখাটি ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দৈনিক ভোরের কাগজ-এ প্রকাশিত হয়েছিলো। আমার খুব পরিশ্রমী লেখা ছিলো এটি।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন