মুক্তিযুদ্ধ ও চলচ্চিত্র
করিম চৌধুরী
উপমহাদেশে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যে দেশটি আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত দখলদার পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে এক অসম ও চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে লাখ লাখ বাঙালি প্রাণ বিসর্জন দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে। অগনিত নারী সম্ভ্রম হারান। কোন পূর্ব সামরিক প্রস্তুতি ছাড়াই রাজাকার, আল বদর, আল শামস্ ব্যতীত গোটা জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। পৃথিবীর কোনো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই ধরণের দৃষ্টান্ত বিরল।
এই ধরণের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধে জাতিকে উজ্জীবিত রাখতে এবং অনুপ্রেরণা যোগাতে কবিতা, গল্প, গান, উপন্যাস, নাটক রচিত হয়। অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী মাধ্যম চলচ্চিত্রে কতটুকু এসেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ? নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে চলচ্চিত্র জাতীয় জীবনে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বলে আমার মনে হয় না ।
যদিও যুদ্ধকালীন সময়ে ৪টি প্রামাণ্যচিত্র তৈরী হয়েছিল কিন্তু অবরুদ্ধ বাংলাদেশে সেগুলো দেখার বা প্রদর্শন করার সুযোগ ছিলো না। ১। Stop Genocide (পরিচালক জহির রায়হান) ২। Liberation Fighters (চিত্রনাট্য, রচনা ও পরিচালনা- আলমগীর কবির) ৩। A State is born ( চিত্রনাট্য, রচনা ও পরিচালনা- জহির রায়হান ) । ৪। Innocent Millions ( পরিচালক-বাবুল চৌধুরী)।
উল্লেখিত ৪টি প্রামাণ্য চিত্রের মধ্যে Stop Genocide নানা কারণে আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ। জহির রায়হান জন্মগতভাবে চলচ্চিত্র নির্মাতা। চলচ্চিত্রের সঙ্গে তাঁর নিবিড়তা ও একাগ্রতা বিপ্লবী চলচ্চিত্রকার - Roberto Rossellnni-র PAISA ছবির নির্মাণ ইতিহাসের সঙ্গে তুলনীয় এবং তা বিখ্যাত সোভিয়েত বিপ্লবের উপর চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই প্রসঙ্গে লেখক মীর্জা তারেকুল কাদের তাঁর বিখ্যাত “বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প” বইতে উল্লেখ করেছেন ‘অত্যন্ত প্রতিকুল অবস্থায় নির্মিত প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী দেখে মুগ্ধ হন এবং ভারতীয় চলচ্চিত্র বিভাগকে ছবিটি ক্রয় করে আন্তর্জাতিকভাবে বিতরণের নির্দেশ দেন’ (পৃষ্ঠা ২২৪)। এ কারণেই প্রামাণ্যচিত্রকে জ্যাঁ ভিগো বলেছেন, তথ্য নির্ভর দৃষ্টিভঙ্গী। ডকুমেন্টারি এই ফিল্মটি বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ পর্যন্ত প্রায় ৩৫টি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক পূর্ন ও স্বল্প দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এবং প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে দু’টি প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে ভারতে। শুকদেব -এর Nine months To freedom এবং পরে গীতা মেহেতা পরিচালিত Dead Line ভারতে প্রদর্শিত হয়।
উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে চাষী নজরুল ইসলামের ‘ওরা ১১ জন’ ‘সংগ্রাম’ সুভাষ দত্তের ‘অরুণোদয়ের অগ্নিস্বাক্ষী’ মমতাজ আলীর ‘রক্তাক্ত বাংলা’ আনন্দের ‘বাঘা বাঙালী’ আলমগীর কবিরের ‘ধীরে বহে মেঘনা’ আলমগীর কুমকুম এর ‘আমার জন্মভূমি’ তানভীর মোকাম্মেল এর ‘হুলিয়া’ ‘নদীর নাম মধুমতি’ ‘স্মৃতি একাত্তর’ খান আতাউর রহমানের ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ‘এখনো অনেক রাত’ নারায়ন ঘোষ মিতার ‘আলোর মিছিল’ হারুনুর রশিদের ‘মেঘের অনেক রং’ শহীদুল হক খানের ‘কলমিলতা’ মোরশেদুল ইসলামের ‘আগামী’ মোস্তফা কামালের ‘প্রত্যাবর্তন’ নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর ‘একাত্তরের যীশু’ আবু সাইয়ীদ এর ‘ধূসর যাত্রা’ মোরশেদুল ইসলামের ‘সূচনা’ হুমায়ুন আহমেদ-এর ‘আগুনের পরশমনি’ ‘শ্যামল ছায়া’ তারেক মাসুদ ও ক্যাথারিন মাসুদ পরিচালিত ‘মুক্তির গান’ তৌকীর আহমেদের জয়যাত্রাসহ ‘চাকা’ ‘মাটির ময়না’ ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’ ‘সেই রাতের কথা বলতে এসেছি’ ‘ইতিহাস কন্যা’ জাপানি চলচ্চিত্রকার নাগিসা ওশিমার ‘বাংলাদেশ ষ্টোরি’ ইত্যাদি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই পূর্ন, স্বল্প দৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্র এবং চলচ্চিত্রে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার অবয়ব ফুটে উঠেছে কি?
মি. আবু নাসের রাজীব ৭ ডিসেম্বর ২০০৪ ‘সংবাদ’- এ লিখেছেন, চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব লুই বুনুয়েল একবার বলেছিলেন-“চলচ্চিত্র পারতো সাদা পর্দায় বিপ্লবের আগুণ ছড়াতে, কিন্তু আমরা তাকে বেশ করে আফিম খাইয়ে শিকল পরিয়ে রেখেছি। পশ্চিমা চলচ্চিত্র সম্পর্কে লেনিনের বক্তব্য ছিল, চলচ্চিত্র যতদিন অর্থলোভী ব্যবসায়ীদের হাতে থাকবে, ততদিন এটা লাভের চেয়ে ক্ষতিই করবে বেশি”।
মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্রগুলো সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বরেণ্য পরিচালক সুভাষ দত্ত বলেন ‘আসলে প্রতিটি চলচ্চিত্র নির্মাণের সময় প্রত্যেক পরিচালকই চেষ্টা করেছেন গল্পে মুক্তিযুদ্ধের আবেগটাকে ফুটিয়ে তুলতে। একেকজন একেকভাবে উপস্থাপন করেছেন। একেকজনের গল্পও ছিল একেক রকম। তবে তিন ঘন্টার একটা চলচ্চিত্রে কখনোই ৯ মাসের দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরা কারো পক্ষে সম্ভব নয়’। এ প্রসঙ্গে তারেক মাসুদ বলেন- ‘সত্যিকার অর্থে যদি একটি চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টিকে তুলে ধরতে চাই তবে সেটা সম্ভব নয়। কেননা এখানে প্রকৃতি জড়িত রয়েছে। মার্চ মাস থেকে আমাকে ছবির শুটিং শুরু করতে হবে। এরপর বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করতে হবে। বৃষ্টিতে গেরিলা যুদ্ধের দৃশ্য ধারণ করতে হবে।এরপর বন্যার দৃশ্যগুলো তুলে ধরতে হবে। তারপরে শীতকালে বিজয়ের মাস। অর্থাৎ পুরো একটি বছর ধরে একটি চলচ্চিত্র শুটিং করতে হবে। কিন্তু এজন্য যে অর্থ এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন, তা পাওয়া যায় না....’।
আমারা দেখি, দেশে দেশে মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে নির্মিত হয়েছে অসংখ্য চলচ্চিত্র। এসব ছবিতে তাদের নানা গৌরব গাঁথাকে কৃতিত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। তাহলে আমরা কেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভাল চলচ্চিত্রের দাবি করতে পারবো না? মুক্তিযুদ্ধের একাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন ববিতা। তাঁর মতে “মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি ছবিতেই নির্মাতা তিন ঘন্টা সময়ের মধ্যেই একটি সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তবে জহির ভাইয়ের Stop Genocide ছিল অসাধারন একটি দলিল। জহির ভাই বেঁচে থাকলে হয়তো তিনি এদেশের চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধকে অনেক ওপরে স্থান দিতে পারতেন। তিনি নেই, তাই এ দূর্লভ সুযোগ থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি’। নায়করাজ রাজ্জাক বললেন- ‘মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই জহির রায়হান তাঁর “জীবন থেকে নেয়া” ছবি নির্মাণের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের স্বাধীনতা দরকার। পরাধীনতার যে কী কষ্ট তা তিনি একটি চাবির গোছা আর সংসারের কয়েকটি মানুষ দিয়ে উপলব্ধি করিয়েছিলেন। আমার মনে হয়, জহির ভাই বেঁচে থাকলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সেরা ছবিটি তিনিই নির্মাণ করতে পারতেন। কিন্তু আফসোস, তিনি নেই, তাই পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ নিয়ে এখানো এদেশ কোন ছবি পায়নি’। নায়ক উজ্জলের মতে, ‘আসলে দেশে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক যতগুলো চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে তার মধ্যে ‘ওরা ১১ জন’ ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ ‘রক্তাক্ত বাংলা’ ‘আলোর মিছিল’ ‘আবার তোরা মানুষ হ’। এই সাদা-কালো চলচ্চিত্রগুলো মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ ছবি’।
চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘ওরা ১১ জন’ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম পূর্নদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। এ ছবিটি নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে চাষী নজরুল ইসলাম বলেন-
-'Ora Egaro Jon' is a milestone in our Film Industry. If this film had not been made the masses would have missed the spirit of the freedom struggle. I got the idea of the theme from the 11-point demand of the students, which motivated our leaders to call for independence. Moreover, the 11 heroes in the film represent the 11 sectors of our freedom struggle.
I formulated the plan to make the film during the Liberation War. Most of the performers and crew of the film are freedom fighters. In February 1972, we started work on the film. In those days, it was really difficult to make a film on the Liberation War. We had no dummy ammunition or explosives to picturise a credible war scene. I got huge support from two people... cinematographer MA Samad and Actor Khosru. We did not have much technical support. However, by using his experience and vast knowledge Samad Bhai could overcome the limitations, Khosru lead all other performers in the war scenes by using real arms and explosives, which is the main aspects of the film".(ডেইলি ষ্টার ১৬ ডিসেম্বর ২০০৪)।
বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার তানভীর মোকাম্মেল কয়েক বছর আগে “সিনেমার শিল্পরূপ” নামে একটি বই লেখেন। এই বইয়ের এক জায়গায় তিনি আক্ষেপের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন ‘বেলারুশিয়ার এক শান্ত গ্রামে ঢুকে গোটা গ্রামটাকে জ্বালিয়ে, গ্রামের সকল নিরীহ নারীপুরুষকে এক পৈশাচিক উল্লাসে হত্যা করেছিল জার্মান সৈন্যরা। পাকিস্তানি সৈন্যরাও এদেশে এরকম অসংখ্য গ্রাম পুড়িয়েছে, অগনন গ্রামবাসীকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। কিন্তু কোথায় ‘কাম অ্যান্ড সি’-র মত চলচ্চিত্র? ষ্টপ জেনোসাইডের ধারাভাষ্যের ভাষায়, হাজার হাজার মাইলাইয়ের ঘটনা ঘটেছে এখানে। কিন্তু কোথায় “ব্যালাড অব এ সোলজার” (Ballad of a Soldier) এর মতো একটি ছবি?
এতোসব কথা বলার পর আমি মনে করি, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মাত্র ৭৫ হাজার টাকায় তৈরী ২০ মিনিটের Stop Genocide ডকুমেন্টারি ফিল্ম হিসেবে সর্বশ্রেষ্ঠ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জহির রায়হান দেশে ফিরে এসে তাঁর ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে বেরিয়ে ছিলেন। তারপর এই বিখ্যাত চলচ্চিত্রকারের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি । Stop Genocide ডকুমেন্টারি ফিল্মটি তৈরী করার পরও এর ছাড়পত্রের জন্য জহির রায়হানকে সুদূর দিল্লী পর্যন্ত দৌঁড়াতে হয়েছে, তদবির করতে হয়েছে ভিনদেশী সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কাছে এবং অবশেষে তাজউদ্দিনের মতো উদারমনা রাজনীতিকের হস্তক্ষেপে ছবিটি সেন্সর করা থেকে মুক্তি পায়। এ ঘটনায় আমরা ক্ষুদ্ধ হতে পারি, কিন্তু হতাশ হই না। কেননা সেই ১৯৫০ সালেই প্রামাণ্য চলচ্চিত্রকার ফ্লাহার্টি বলে গিয়েছেন, আমাদের মনের কথাটি-‘গণমাধ্যমের মধ্যে চলচ্চিত্র হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী, বিশ্বাসযোগ্য ও সর্বব্যাপক। এর শক্তি, বিশ্বাসযোগ্যতা, বর্ণনা ক্ষমতা, আবেগমূলক প্রভাব ও নাটকীয়তা সৃষ্টি যে কতো জোরালো হতে পারে তা যদি ফিল্ম ইন্ডাষ্ট্রির শীর্ষে বসে আছেন যারা, তারা বুঝতেন তবে একটা কাজের কাজ হতো। আমাদের চলচ্চিত্রের কর্তাব্যক্তিরা ফিল্মকে বলেন ‘মাল’ আর তাদের উদ্দেশ্য ‘কেবল ব্যবসা করা’ (দেখুন-‘মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র’-জাকির হোসেন রাজু। পৃষ্ঠা-৭৬)।
আজ যারা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তাদের প্রতি আমার প্রশ্ন ‘খাইছি তোরে’ ‘শান্ত কেন মাস্তান’সহ আরো অনেক কুরুচিপূর্ন চলচ্চিত্র তৈরি করতে আপনাদের লজ্জা করে না? এই রুচির পরিবর্তন না হলে, ভবিষ্যতে হয়তো ‘আজকের হারামজাদা- কালকের শুয়রের বাচ্চা জাতীয় নামের চলচ্চিত্রও আমরা পাবো।
চলচ্চিত্রে কুরুচিপূর্ন নাম ও কাহিনীর অচিরেই অবসান ঘটবে এই প্রত্যাশা সকলের।
তথ্যসূত্র: ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস’ দৈনিক সংবাদ, ডেইলি ষ্টার, প্রথম আলো, জনকন্ঠ, ‘মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র’-জাকির হোসেন রাজু, ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প’-মির্জা তারেকুল কাদের।
করিম চৌধুরী
১০ই মার্চ ২০০৫
ইমেল : karimcbd@gmail.com
লেখাটি ২০০৫ সালের মার্চ মাসে দৈনিক ভোরের কাগজ-এ প্রকাশিত হয়েছিলো।।
করিম চৌধুরী
উপমহাদেশে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যে দেশটি আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত দখলদার পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে এক অসম ও চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে লাখ লাখ বাঙালি প্রাণ বিসর্জন দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে। অগনিত নারী সম্ভ্রম হারান। কোন পূর্ব সামরিক প্রস্তুতি ছাড়াই রাজাকার, আল বদর, আল শামস্ ব্যতীত গোটা জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। পৃথিবীর কোনো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই ধরণের দৃষ্টান্ত বিরল।
এই ধরণের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধে জাতিকে উজ্জীবিত রাখতে এবং অনুপ্রেরণা যোগাতে কবিতা, গল্প, গান, উপন্যাস, নাটক রচিত হয়। অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী মাধ্যম চলচ্চিত্রে কতটুকু এসেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ? নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে চলচ্চিত্র জাতীয় জীবনে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বলে আমার মনে হয় না ।
যদিও যুদ্ধকালীন সময়ে ৪টি প্রামাণ্যচিত্র তৈরী হয়েছিল কিন্তু অবরুদ্ধ বাংলাদেশে সেগুলো দেখার বা প্রদর্শন করার সুযোগ ছিলো না। ১। Stop Genocide (পরিচালক জহির রায়হান) ২। Liberation Fighters (চিত্রনাট্য, রচনা ও পরিচালনা- আলমগীর কবির) ৩। A State is born ( চিত্রনাট্য, রচনা ও পরিচালনা- জহির রায়হান ) । ৪। Innocent Millions ( পরিচালক-বাবুল চৌধুরী)।
উল্লেখিত ৪টি প্রামাণ্য চিত্রের মধ্যে Stop Genocide নানা কারণে আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ। জহির রায়হান জন্মগতভাবে চলচ্চিত্র নির্মাতা। চলচ্চিত্রের সঙ্গে তাঁর নিবিড়তা ও একাগ্রতা বিপ্লবী চলচ্চিত্রকার - Roberto Rossellnni-র PAISA ছবির নির্মাণ ইতিহাসের সঙ্গে তুলনীয় এবং তা বিখ্যাত সোভিয়েত বিপ্লবের উপর চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই প্রসঙ্গে লেখক মীর্জা তারেকুল কাদের তাঁর বিখ্যাত “বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প” বইতে উল্লেখ করেছেন ‘অত্যন্ত প্রতিকুল অবস্থায় নির্মিত প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী দেখে মুগ্ধ হন এবং ভারতীয় চলচ্চিত্র বিভাগকে ছবিটি ক্রয় করে আন্তর্জাতিকভাবে বিতরণের নির্দেশ দেন’ (পৃষ্ঠা ২২৪)। এ কারণেই প্রামাণ্যচিত্রকে জ্যাঁ ভিগো বলেছেন, তথ্য নির্ভর দৃষ্টিভঙ্গী। ডকুমেন্টারি এই ফিল্মটি বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ পর্যন্ত প্রায় ৩৫টি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক পূর্ন ও স্বল্প দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এবং প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে দু’টি প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে ভারতে। শুকদেব -এর Nine months To freedom এবং পরে গীতা মেহেতা পরিচালিত Dead Line ভারতে প্রদর্শিত হয়।
উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে চাষী নজরুল ইসলামের ‘ওরা ১১ জন’ ‘সংগ্রাম’ সুভাষ দত্তের ‘অরুণোদয়ের অগ্নিস্বাক্ষী’ মমতাজ আলীর ‘রক্তাক্ত বাংলা’ আনন্দের ‘বাঘা বাঙালী’ আলমগীর কবিরের ‘ধীরে বহে মেঘনা’ আলমগীর কুমকুম এর ‘আমার জন্মভূমি’ তানভীর মোকাম্মেল এর ‘হুলিয়া’ ‘নদীর নাম মধুমতি’ ‘স্মৃতি একাত্তর’ খান আতাউর রহমানের ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ‘এখনো অনেক রাত’ নারায়ন ঘোষ মিতার ‘আলোর মিছিল’ হারুনুর রশিদের ‘মেঘের অনেক রং’ শহীদুল হক খানের ‘কলমিলতা’ মোরশেদুল ইসলামের ‘আগামী’ মোস্তফা কামালের ‘প্রত্যাবর্তন’ নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর ‘একাত্তরের যীশু’ আবু সাইয়ীদ এর ‘ধূসর যাত্রা’ মোরশেদুল ইসলামের ‘সূচনা’ হুমায়ুন আহমেদ-এর ‘আগুনের পরশমনি’ ‘শ্যামল ছায়া’ তারেক মাসুদ ও ক্যাথারিন মাসুদ পরিচালিত ‘মুক্তির গান’ তৌকীর আহমেদের জয়যাত্রাসহ ‘চাকা’ ‘মাটির ময়না’ ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’ ‘সেই রাতের কথা বলতে এসেছি’ ‘ইতিহাস কন্যা’ জাপানি চলচ্চিত্রকার নাগিসা ওশিমার ‘বাংলাদেশ ষ্টোরি’ ইত্যাদি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই পূর্ন, স্বল্প দৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্র এবং চলচ্চিত্রে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার অবয়ব ফুটে উঠেছে কি?
মি. আবু নাসের রাজীব ৭ ডিসেম্বর ২০০৪ ‘সংবাদ’- এ লিখেছেন, চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব লুই বুনুয়েল একবার বলেছিলেন-“চলচ্চিত্র পারতো সাদা পর্দায় বিপ্লবের আগুণ ছড়াতে, কিন্তু আমরা তাকে বেশ করে আফিম খাইয়ে শিকল পরিয়ে রেখেছি। পশ্চিমা চলচ্চিত্র সম্পর্কে লেনিনের বক্তব্য ছিল, চলচ্চিত্র যতদিন অর্থলোভী ব্যবসায়ীদের হাতে থাকবে, ততদিন এটা লাভের চেয়ে ক্ষতিই করবে বেশি”।
মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্রগুলো সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বরেণ্য পরিচালক সুভাষ দত্ত বলেন ‘আসলে প্রতিটি চলচ্চিত্র নির্মাণের সময় প্রত্যেক পরিচালকই চেষ্টা করেছেন গল্পে মুক্তিযুদ্ধের আবেগটাকে ফুটিয়ে তুলতে। একেকজন একেকভাবে উপস্থাপন করেছেন। একেকজনের গল্পও ছিল একেক রকম। তবে তিন ঘন্টার একটা চলচ্চিত্রে কখনোই ৯ মাসের দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরা কারো পক্ষে সম্ভব নয়’। এ প্রসঙ্গে তারেক মাসুদ বলেন- ‘সত্যিকার অর্থে যদি একটি চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টিকে তুলে ধরতে চাই তবে সেটা সম্ভব নয়। কেননা এখানে প্রকৃতি জড়িত রয়েছে। মার্চ মাস থেকে আমাকে ছবির শুটিং শুরু করতে হবে। এরপর বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করতে হবে। বৃষ্টিতে গেরিলা যুদ্ধের দৃশ্য ধারণ করতে হবে।এরপর বন্যার দৃশ্যগুলো তুলে ধরতে হবে। তারপরে শীতকালে বিজয়ের মাস। অর্থাৎ পুরো একটি বছর ধরে একটি চলচ্চিত্র শুটিং করতে হবে। কিন্তু এজন্য যে অর্থ এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন, তা পাওয়া যায় না....’।
আমারা দেখি, দেশে দেশে মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে নির্মিত হয়েছে অসংখ্য চলচ্চিত্র। এসব ছবিতে তাদের নানা গৌরব গাঁথাকে কৃতিত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। তাহলে আমরা কেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভাল চলচ্চিত্রের দাবি করতে পারবো না? মুক্তিযুদ্ধের একাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন ববিতা। তাঁর মতে “মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি ছবিতেই নির্মাতা তিন ঘন্টা সময়ের মধ্যেই একটি সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তবে জহির ভাইয়ের Stop Genocide ছিল অসাধারন একটি দলিল। জহির ভাই বেঁচে থাকলে হয়তো তিনি এদেশের চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধকে অনেক ওপরে স্থান দিতে পারতেন। তিনি নেই, তাই এ দূর্লভ সুযোগ থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি’। নায়করাজ রাজ্জাক বললেন- ‘মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই জহির রায়হান তাঁর “জীবন থেকে নেয়া” ছবি নির্মাণের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের স্বাধীনতা দরকার। পরাধীনতার যে কী কষ্ট তা তিনি একটি চাবির গোছা আর সংসারের কয়েকটি মানুষ দিয়ে উপলব্ধি করিয়েছিলেন। আমার মনে হয়, জহির ভাই বেঁচে থাকলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সেরা ছবিটি তিনিই নির্মাণ করতে পারতেন। কিন্তু আফসোস, তিনি নেই, তাই পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ নিয়ে এখানো এদেশ কোন ছবি পায়নি’। নায়ক উজ্জলের মতে, ‘আসলে দেশে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক যতগুলো চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে তার মধ্যে ‘ওরা ১১ জন’ ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ ‘রক্তাক্ত বাংলা’ ‘আলোর মিছিল’ ‘আবার তোরা মানুষ হ’। এই সাদা-কালো চলচ্চিত্রগুলো মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ ছবি’।
চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘ওরা ১১ জন’ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম পূর্নদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। এ ছবিটি নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে চাষী নজরুল ইসলাম বলেন-
-'Ora Egaro Jon' is a milestone in our Film Industry. If this film had not been made the masses would have missed the spirit of the freedom struggle. I got the idea of the theme from the 11-point demand of the students, which motivated our leaders to call for independence. Moreover, the 11 heroes in the film represent the 11 sectors of our freedom struggle.
I formulated the plan to make the film during the Liberation War. Most of the performers and crew of the film are freedom fighters. In February 1972, we started work on the film. In those days, it was really difficult to make a film on the Liberation War. We had no dummy ammunition or explosives to picturise a credible war scene. I got huge support from two people... cinematographer MA Samad and Actor Khosru. We did not have much technical support. However, by using his experience and vast knowledge Samad Bhai could overcome the limitations, Khosru lead all other performers in the war scenes by using real arms and explosives, which is the main aspects of the film".(ডেইলি ষ্টার ১৬ ডিসেম্বর ২০০৪)।
বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার তানভীর মোকাম্মেল কয়েক বছর আগে “সিনেমার শিল্পরূপ” নামে একটি বই লেখেন। এই বইয়ের এক জায়গায় তিনি আক্ষেপের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন ‘বেলারুশিয়ার এক শান্ত গ্রামে ঢুকে গোটা গ্রামটাকে জ্বালিয়ে, গ্রামের সকল নিরীহ নারীপুরুষকে এক পৈশাচিক উল্লাসে হত্যা করেছিল জার্মান সৈন্যরা। পাকিস্তানি সৈন্যরাও এদেশে এরকম অসংখ্য গ্রাম পুড়িয়েছে, অগনন গ্রামবাসীকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। কিন্তু কোথায় ‘কাম অ্যান্ড সি’-র মত চলচ্চিত্র? ষ্টপ জেনোসাইডের ধারাভাষ্যের ভাষায়, হাজার হাজার মাইলাইয়ের ঘটনা ঘটেছে এখানে। কিন্তু কোথায় “ব্যালাড অব এ সোলজার” (Ballad of a Soldier) এর মতো একটি ছবি?
এতোসব কথা বলার পর আমি মনে করি, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মাত্র ৭৫ হাজার টাকায় তৈরী ২০ মিনিটের Stop Genocide ডকুমেন্টারি ফিল্ম হিসেবে সর্বশ্রেষ্ঠ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জহির রায়হান দেশে ফিরে এসে তাঁর ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে বেরিয়ে ছিলেন। তারপর এই বিখ্যাত চলচ্চিত্রকারের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি । Stop Genocide ডকুমেন্টারি ফিল্মটি তৈরী করার পরও এর ছাড়পত্রের জন্য জহির রায়হানকে সুদূর দিল্লী পর্যন্ত দৌঁড়াতে হয়েছে, তদবির করতে হয়েছে ভিনদেশী সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কাছে এবং অবশেষে তাজউদ্দিনের মতো উদারমনা রাজনীতিকের হস্তক্ষেপে ছবিটি সেন্সর করা থেকে মুক্তি পায়। এ ঘটনায় আমরা ক্ষুদ্ধ হতে পারি, কিন্তু হতাশ হই না। কেননা সেই ১৯৫০ সালেই প্রামাণ্য চলচ্চিত্রকার ফ্লাহার্টি বলে গিয়েছেন, আমাদের মনের কথাটি-‘গণমাধ্যমের মধ্যে চলচ্চিত্র হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী, বিশ্বাসযোগ্য ও সর্বব্যাপক। এর শক্তি, বিশ্বাসযোগ্যতা, বর্ণনা ক্ষমতা, আবেগমূলক প্রভাব ও নাটকীয়তা সৃষ্টি যে কতো জোরালো হতে পারে তা যদি ফিল্ম ইন্ডাষ্ট্রির শীর্ষে বসে আছেন যারা, তারা বুঝতেন তবে একটা কাজের কাজ হতো। আমাদের চলচ্চিত্রের কর্তাব্যক্তিরা ফিল্মকে বলেন ‘মাল’ আর তাদের উদ্দেশ্য ‘কেবল ব্যবসা করা’ (দেখুন-‘মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র’-জাকির হোসেন রাজু। পৃষ্ঠা-৭৬)।
আজ যারা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তাদের প্রতি আমার প্রশ্ন ‘খাইছি তোরে’ ‘শান্ত কেন মাস্তান’সহ আরো অনেক কুরুচিপূর্ন চলচ্চিত্র তৈরি করতে আপনাদের লজ্জা করে না? এই রুচির পরিবর্তন না হলে, ভবিষ্যতে হয়তো ‘আজকের হারামজাদা- কালকের শুয়রের বাচ্চা জাতীয় নামের চলচ্চিত্রও আমরা পাবো।
চলচ্চিত্রে কুরুচিপূর্ন নাম ও কাহিনীর অচিরেই অবসান ঘটবে এই প্রত্যাশা সকলের।
তথ্যসূত্র: ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস’ দৈনিক সংবাদ, ডেইলি ষ্টার, প্রথম আলো, জনকন্ঠ, ‘মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র’-জাকির হোসেন রাজু, ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প’-মির্জা তারেকুল কাদের।
করিম চৌধুরী
১০ই মার্চ ২০০৫
ইমেল : karimcbd@gmail.com
লেখাটি ২০০৫ সালের মার্চ মাসে দৈনিক ভোরের কাগজ-এ প্রকাশিত হয়েছিলো।।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন