সারারাতই বৃষ্টি ছিলো । ঘুম থেকে উঠলাম আটটায় । প্রচুর বৃষ্টি । এক সময়
বৃষ্টিতে ভেজা খুব শখ ছিলো । ছাত্র জীবনে ‘বর্ষা’ নামের একটি প্রবন্ধ
আমাদের পাঠ্য ছিলো । লেখক প্রমথ চৌধুরী ।
লেখকের নামটি লিখতে এবং বলতে প্রায়ই ভুল করতাম । আমি বলতাম, প্রথম চৌধুরী ।
সহপাঠিরা কিছুদিন আমাকে প্রথম চৌধুরী বলেও ডেকেছিলো ।
ভিয়েনা থেকে বেড়াতে এসেছিলাম দেশে । সেই কবে । আমি গ্রামের বাড়ি কম থেকেছি । তো সেবার গ্রামের বাড়িতে কয়েকদিন ছিলাম । এক দুপুরে মুষলধারে বৃষ্টি নামলো । শর্টস (হাফপ্যান্ট)পড়ে দৌঁড়ে পুকুরপাড়ে এসে দাঁড়ালাম । অনেকক্ষণ ভিজে যখন শীত শীত লাগছিলো তখন ঘরে এসে শরীর মুছছিলাম । এমন সময় আমার প্রয়াত প্রিয় মা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, ‘‘বাড়ির সবাই বলাবলি করছে,তুই নাকি বিদেশে থেকে পাগল হয়ে গেছস । কোনো সুস্থ মানুষ দরকার ছাড়া এভাবে বৃষ্টিতে ভিজে ? আমার কাছে ছোট হইলেও অন্যদের চোখে তুই বড় হইছস । এখনো কেনো হাফপ্যান্ট পড়স ? তুই কি ফুটবল খেলোয়ার ?”
মাকে রাগানোর জন্য বললাম, মা, গরমের দিন হাফপ্যান্ট পড়তে অনেক মজা । বিদেশে তোমার মতো বৃদ্ধারাও হাফপ্যান্ট পরে ঘুরে বেড়ায় । আমাদের দেশে তো তুমি হাফপ্যান্ট পরে ঘুরতে পারবা না । আমার বেশ কয়েকটা হাফপ্যান্ট আছে । রাতে তুমি একটা হাফপ্যান্ট পরে ঘুমিয়ে দেখো কী মজা !
আমার ৭৫ বছর বয়সি সাদা শাড়ী পড়া বিধবা মা অবাক হয়ে বললেন, তওবা তওবা , নাউজুবিল্লাহ । তুই এসব কি বলছ ! আমারো তো এখন সন্দেহ লাগতাছে, তোর মাথা কি ঠিক আছে ? সেদিন মা আমার ভেজা শরীরে জড়িয়ে ধরে গালে গাল লাগিয়ে বলেছিলেন, তুই কেন এতো পাগলামি করস ? সারাক্ষণ মাথায় দুষ্টুমি । আমার সাথে দুষ্টুমি কর । বাইরের মানুষকে এসব বলবি না । এরা তোর দুষ্টুমি না বুঝে তোরে পাগল কইবো । আমার শুনলে কষ্ট লাগবো ।
এরপর মা আমাকে খাটে বসিয়ে নিজ হাতে টাওয়েল দিয়ে আমার সারা শরীর মুছে দিয়েছিলেন । মাথা মোছার সময় মা আমার চুলে মোট করে ধরে আস্তে টান দিয়ে বলেছিলেন, আমার পেটে যে এমন বান্দর একটা হইবো তা আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবি নাই ।
মনে আছে ছোট বেলার কথা । ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে শিলাবৃষ্টির সময় কাঁচা আম ঝরে পরতো । ঝড় বৃষ্টির পর প্রকৃতি শান্ত হলেও আমরা অবুঝ বালকরা হতাম অশান্ত । বাজারের ব্যাগ নিয়ে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে আম কুড়োতাম । সমবয়সিদের সঙ্গে আম নিয়ে কাড়াকাড়ি থেকে মারামারি পর্যন্ত হতো । সারা শরীর কাদায় কাদাময় ।
বোন ভাবীরা আমের ভর্তা বানিয়ে নিজেরা বেশিটুকু রেখে আমাদের সামান্যই দিতেন । বেশির জন্য কান্নাকাটি করেও কোনো লাভ হতো না । ধমকের সূরে উপদেশ দিয়ে বলতেন, ছেলেদের বেশি টক খাওয়া ভালো না ।
আর ছিলো চুরি । এটাতো মাস্ট । বেশ কয়েকঘন্টা বৃষ্টির পর আমরা বেড়িয়ে পড়তাম মাছ চুরির অভিযানে । পুকুর, ডোবা ও ক্ষেতের অতিরিক্ত পানি যেখান দিয়ে বের হয়ে যেতো সেখানে পানির স্রোতের উল্টো দিকে উঠে আসতো বিভিন্ন প্রজাতির মাছ । কৈ, শিং, মাগুর, টাকি, টেংরা, শোল কখনো কখনো বোয়াল মাছও পাওয়া যেতো । কৈ মাছ তো কানকো দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ডাঙায় চলে আসতো । চুরি এই জন্য যে, ওইসব পুকুর,ডোবা ও ক্ষেতের মালিক ছাড়া অন্য কেউ এই মাছ ধরতে পারবে না বলে অলিখিত নিয়ম ছিলো । কিন্তু দুরন্ত বালকদের কে রুখে ? শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের ইন্দ্রনাথকেও আমরা হারিয়ে দিতাম দুরন্তপনায় ।
আর বন্যার সময় রাজনীতিবিদরা দুর্গত এলাকার লোকদের রিলিফ দিতেন । একবার দৈনিক সংবাদ ত্রাণ নিয়ে শিরোনাম করলোঃ “ফটু তোলা শ্যাষ- রিলিফ দেওয়া শ্যাষ।” আমরা ছোটবেলা থেকেই রাজনীতিবিদদের চিটিং দেখে আসছি । টিভি ক্যামেরা চালিয়ে কয়েকজনকে কাপড় আর প্যাকেট খাবার দেন । ক্যামেরা অফ রিলিফ দেয়া বন্ধ । উনারা কতো সাহায্য করছেন তা বিটিভিতে দেখানো হতো । অষ্টাশির বন্যায় তো তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এরশাদ মানুষের দুর্দশা দেখে হেলিকপ্টারে বসে গানও লিখেছেন । সেই গান বিটিভিতে দেখানো হতো প্রতিদিন ।“তোমাদের পাশে এসে জীবনের সাথী হতে আজকের চেষ্টা আমার।” গীতিকার হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ।
বৃষ্টি নিয়ে আমার খুব প্রিয় একটা গান ।
ভিয়েনা থেকে বেড়াতে এসেছিলাম দেশে । সেই কবে । আমি গ্রামের বাড়ি কম থেকেছি । তো সেবার গ্রামের বাড়িতে কয়েকদিন ছিলাম । এক দুপুরে মুষলধারে বৃষ্টি নামলো । শর্টস (হাফপ্যান্ট)পড়ে দৌঁড়ে পুকুরপাড়ে এসে দাঁড়ালাম । অনেকক্ষণ ভিজে যখন শীত শীত লাগছিলো তখন ঘরে এসে শরীর মুছছিলাম । এমন সময় আমার প্রয়াত প্রিয় মা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, ‘‘বাড়ির সবাই বলাবলি করছে,তুই নাকি বিদেশে থেকে পাগল হয়ে গেছস । কোনো সুস্থ মানুষ দরকার ছাড়া এভাবে বৃষ্টিতে ভিজে ? আমার কাছে ছোট হইলেও অন্যদের চোখে তুই বড় হইছস । এখনো কেনো হাফপ্যান্ট পড়স ? তুই কি ফুটবল খেলোয়ার ?”
মাকে রাগানোর জন্য বললাম, মা, গরমের দিন হাফপ্যান্ট পড়তে অনেক মজা । বিদেশে তোমার মতো বৃদ্ধারাও হাফপ্যান্ট পরে ঘুরে বেড়ায় । আমাদের দেশে তো তুমি হাফপ্যান্ট পরে ঘুরতে পারবা না । আমার বেশ কয়েকটা হাফপ্যান্ট আছে । রাতে তুমি একটা হাফপ্যান্ট পরে ঘুমিয়ে দেখো কী মজা !
আমার ৭৫ বছর বয়সি সাদা শাড়ী পড়া বিধবা মা অবাক হয়ে বললেন, তওবা তওবা , নাউজুবিল্লাহ । তুই এসব কি বলছ ! আমারো তো এখন সন্দেহ লাগতাছে, তোর মাথা কি ঠিক আছে ? সেদিন মা আমার ভেজা শরীরে জড়িয়ে ধরে গালে গাল লাগিয়ে বলেছিলেন, তুই কেন এতো পাগলামি করস ? সারাক্ষণ মাথায় দুষ্টুমি । আমার সাথে দুষ্টুমি কর । বাইরের মানুষকে এসব বলবি না । এরা তোর দুষ্টুমি না বুঝে তোরে পাগল কইবো । আমার শুনলে কষ্ট লাগবো ।
এরপর মা আমাকে খাটে বসিয়ে নিজ হাতে টাওয়েল দিয়ে আমার সারা শরীর মুছে দিয়েছিলেন । মাথা মোছার সময় মা আমার চুলে মোট করে ধরে আস্তে টান দিয়ে বলেছিলেন, আমার পেটে যে এমন বান্দর একটা হইবো তা আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবি নাই ।
মনে আছে ছোট বেলার কথা । ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে শিলাবৃষ্টির সময় কাঁচা আম ঝরে পরতো । ঝড় বৃষ্টির পর প্রকৃতি শান্ত হলেও আমরা অবুঝ বালকরা হতাম অশান্ত । বাজারের ব্যাগ নিয়ে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে আম কুড়োতাম । সমবয়সিদের সঙ্গে আম নিয়ে কাড়াকাড়ি থেকে মারামারি পর্যন্ত হতো । সারা শরীর কাদায় কাদাময় ।
বোন ভাবীরা আমের ভর্তা বানিয়ে নিজেরা বেশিটুকু রেখে আমাদের সামান্যই দিতেন । বেশির জন্য কান্নাকাটি করেও কোনো লাভ হতো না । ধমকের সূরে উপদেশ দিয়ে বলতেন, ছেলেদের বেশি টক খাওয়া ভালো না ।
আর ছিলো চুরি । এটাতো মাস্ট । বেশ কয়েকঘন্টা বৃষ্টির পর আমরা বেড়িয়ে পড়তাম মাছ চুরির অভিযানে । পুকুর, ডোবা ও ক্ষেতের অতিরিক্ত পানি যেখান দিয়ে বের হয়ে যেতো সেখানে পানির স্রোতের উল্টো দিকে উঠে আসতো বিভিন্ন প্রজাতির মাছ । কৈ, শিং, মাগুর, টাকি, টেংরা, শোল কখনো কখনো বোয়াল মাছও পাওয়া যেতো । কৈ মাছ তো কানকো দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ডাঙায় চলে আসতো । চুরি এই জন্য যে, ওইসব পুকুর,ডোবা ও ক্ষেতের মালিক ছাড়া অন্য কেউ এই মাছ ধরতে পারবে না বলে অলিখিত নিয়ম ছিলো । কিন্তু দুরন্ত বালকদের কে রুখে ? শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের ইন্দ্রনাথকেও আমরা হারিয়ে দিতাম দুরন্তপনায় ।
আর বন্যার সময় রাজনীতিবিদরা দুর্গত এলাকার লোকদের রিলিফ দিতেন । একবার দৈনিক সংবাদ ত্রাণ নিয়ে শিরোনাম করলোঃ “ফটু তোলা শ্যাষ- রিলিফ দেওয়া শ্যাষ।” আমরা ছোটবেলা থেকেই রাজনীতিবিদদের চিটিং দেখে আসছি । টিভি ক্যামেরা চালিয়ে কয়েকজনকে কাপড় আর প্যাকেট খাবার দেন । ক্যামেরা অফ রিলিফ দেয়া বন্ধ । উনারা কতো সাহায্য করছেন তা বিটিভিতে দেখানো হতো । অষ্টাশির বন্যায় তো তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এরশাদ মানুষের দুর্দশা দেখে হেলিকপ্টারে বসে গানও লিখেছেন । সেই গান বিটিভিতে দেখানো হতো প্রতিদিন ।“তোমাদের পাশে এসে জীবনের সাথী হতে আজকের চেষ্টা আমার।” গীতিকার হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ।
বৃষ্টি নিয়ে আমার খুব প্রিয় একটা গান ।
“ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো না
আমার এতো সাধের কান্নার দাগ ধুয়ো না
সে যেন এসেই দেখে
পথ চেয়ে তার কেমন করে কেঁদেছি ।
ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো না ।
দোহাই গানের বীণা
মনকে ভরে তোলো না
দেখেই তাকে দেখার এই গান ভুলো না
সে যেন এসেই শোনে তার বিরহে কি সূর আমি সেধেছি ।
ক্লান্ত প্রদীপ ওগো
হঠাৎ আলোয় ফোটো না
দেখেই তাকে উজল হয়ে উঠো না
সে যেন এসেই জানে কোন আঁধারে
এ রাত আমি বেঁধেছি ।
ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো না।’’
আমার এতো সাধের কান্নার দাগ ধুয়ো না
সে যেন এসেই দেখে
পথ চেয়ে তার কেমন করে কেঁদেছি ।
ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো না ।
দোহাই গানের বীণা
মনকে ভরে তোলো না
দেখেই তাকে দেখার এই গান ভুলো না
সে যেন এসেই শোনে তার বিরহে কি সূর আমি সেধেছি ।
ক্লান্ত প্রদীপ ওগো
হঠাৎ আলোয় ফোটো না
দেখেই তাকে উজল হয়ে উঠো না
সে যেন এসেই জানে কোন আঁধারে
এ রাত আমি বেঁধেছি ।
ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো না।’’
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন