সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

নিম্মি আপা ও গান

নিম্মি আপা ও গান

ছাত্রজীবনে সব বন্ধু, ক্লাসমেট, ইয়ারমেটের চেয়ে আমার কাছে সবচেয়ে বেশি গান আর বইয়ের কালেকশন ছিলো। আমাদের সময় অডিও ক্যাসেট ছিলো। ক্যাসেট রাখার জন্য আমার আলাদা একটা র‍্যাক ছিলো। সব ক্যাসেটে ছোট করে গানের প্রথম লাইন আর শিল্পির নাম লিখে রাখাতাম। যে গান বেশি ভালো লাগতো তা রিওয়াইন্ড করে বার বার শুনতাম।
কান্দিরপাড় 'বাসরী' আর 'সানাই' নামে দুইটি অডিও ভিডিও দোকান ছিলো। তখন আমরা ক্যাসেট কিনে ওদের কাছে গানের লিস্ট দিতাম। কোনটার পর কোন গান সে হিসেবে কাগজে লিখে লিস্ট দিতাম। ৬০ মিনিটের একটা ক্যাসেটে দুই দিকে সর্বোচ্চ ২০ টি গান কপি করা যেতো । আর ছিলো ৯০ মিনিটের ক্যাসেট। Maxell, TDK, Sony দামি ক্যাসেট ছিলো। ক্যাসেট দেয়া নেয়া, গল্প, উপন্যাস, কবিতার বই আদান প্রধানের কারনে অনেক মেয়েবন্ধু আমাকে পছন্দ করতো । অনেক সিনিয়র আপারাও আমার কালেকশনের গান শোনে আমাকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতেন । খালি গলায় নিজেও ভালো গাইতাম । কবিতা আবৃতি করতাম ।
তখন ওইসব দোকানে কোনো নতুন বাংলা গাল এলে ওরা বড় স্পিকার দিয়ে ফুল ভলিউমে গানটা বাজাতো। হিন্দি গানের দাপট তখনো শুরু হয়নি ।
দু'টো দোকানই ছিলো ফার্স্ট ফ্লোরে। একমাত্র ঘুমের সময় ছাড়া আমরা সারাদিন রাত কান্দিরপাড়।
সে সময় ঢাকা- কুমিল্লা ভালো বাস সার্ভিস ছিলো দু'টো ।
১। পিপলস ট্রান্সপোর্ট
২। উইনার ট্রান্সপোর্ট
বাসে পুরো জার্নিতেই গান বাজানো হতো তখন। আমরা কয়েকবন্ধু ঢাকা যাওয়া- আসার সময় ক্যাসেট নিয়ে উঠতাম। উঠার সঙ্গেই হেল্পারকে বলে দিতাম এই ক্যাসেটটাই ঢাকা পর্যন্ত বাজাবা। কারন আমি নিশ্চিত ছিলাম গানগুলো সকলের ভালো লাগবে । ওরা আমাদের চিনতো । তাই আমাদের কথা শুনতো। একদিন ঢাকা যাওয়ার সময় ক্যান্টনমেন্ট থেকে দু'জন আর্মি অফিসারের ওয়াইফ উঠলেন। আমরা শহর থেকেই উঠেছি । আমার ক্যাসেট তখন গাড়িতে বাজছিলো। ৪ নাম্বারে অমৃত অরোরা সিং এর এই গানটা বাজলো।
রূপসী দোহাই তোমার
তোমার ওই চোখের পাতায়
আমাকে কাজল লতার কালি করো
।'

গানটা শেষ হলে একজন আর্মি অফিসারের ওয়াইফ হেল্পারকে ডেকে বললেন,
- এই ছেলে, তোমাদের এই ক্যাসেটটা আমি কিনে নেবো। তোমরা আরেকটা ক্যাসেট কিনে নিও।
- ম্যাডাম ক্যাসেটটা গাড়ির না। এক প্যাসেঞ্জারের।
(আমরা সব সময় ড্রাইভারের ঠিক পেছনের সীটগুলো নিতাম। সবার সামনে বসবো আর বন্ধুরা ফান করবো।)
- কার ?
হেল্পার ছেলেটা আঙুল দিয়ে আমাদের দেখালো।
- এক্সকিউজ মি, এই গানটা আমি কিভাবে পেতে পারি ? কাইন্ডলি বলবেন ? বন্ধুদের মাঝে আমি খুবই চঞ্চল, জড়তাহীন আর ভালো ছাত্র ছিলাম । মানুষ বলে, দেখতেও সুন্দর ছিলাম ।
- আমি : যে কোনো অডিও ভিডিও দোকানে গিয়ে গানটার প্রথম লাইন আর শিল্পীর নাম বললেই রেকর্ড করে দেবে আপা।
দুই, এই ক্যাসেট টা আমি আপনাকে গিফট করলে পেতে পারেন। এছাড়া পাওয়ার আর কোনো রাস্তা নেই।
- আমরা তো এতো ঘুরাঘুরি করি না। আপনি যদি ক্যাসেটটা আমাকে দিন আমার খুব ভালো লাগবে।
আমি তখন ছোট মানুষ। ইন্টার পাস করেছি মাত্র। তিনি অনেক সিনিয়র। তিনি নিজেই পরিচয় দিলেন, তাদের বাড়ি বগুড়া । বাবা জেলা শিক্ষা অফিসার ছিলেন। উনার হাসব্যান্ড লে.ক. ফজলুর রহমান। কুমিল্লা সেনানিবাসে ১২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিও। তিনি দেখতে বেশ সুন্দরী ছিলেন। বেশ। সদ্য উচ্চ মাধ্যমিক পাস একটি ছেলের কাছে এমন সুন্দরী মহিলা স্বপ্নের রানীর মতোই ।
আমি ইন্টার দিয়ে রেজাটের আগেই ভাইভা আর মেডিকেল টেস্ট পাস করেছি ১৩ বিএমএ লং কোর্সে।
এখন রিটেন। পাস করলে ISSB. ইতিমধ্যে আমার ইন্টার রেজাল্ট আউট হয়েছে। এসএসসির মতোই ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছি।
তিনি ছোট ভাইয়ের মতো আমাকে আদুরে ভাষায় 'তুমি' করে বলতে লাগলেন।
আমি হেল্পারকে বলে ক্যাসেট টা ইজেক্ট করে কাভারসহ উনার হাতে দিলাম।
উনি একটা কাগজে বাসা এবং উনার হাসব্যান্ডের অফিসের ফোন নাম্বার লিখে দিয়ে বাসায় যাওয়ার দাওয়াত দিলেন। আমি তখন প্রয়াত মেজো আপার বাসা সোনালী ব্যাংক কর্পোরেট অফিসের পেছনে 'আনোয়ারা ভিলা'য় থাকতাম। ওই বাসার গেইটের ভেতরে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা ছিলো।
একদিন আমি বাসার পাশেই উজির দিঘীর পাড় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারছিলাম। আপা বাসা থেকে খবর পাঠালেন, এক আর্মি অফিসারের বউ এসে আমার খোঁজ নিচ্ছেন। আমি উভয় পরীক্ষায় ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছি কিনা? এখন আমি কোথায়? বাসার সব রুম ঘুরে দেখেছেন। আপা কিছুটা ভয় পেয়ে গেছেন। বাসার সামনে লেফট্যানান্ট কর্নেলের গাড়ি। আমি একটা পিচ্চি পোলা তখন। কোথাও কোনো অঘটন না ঘটিয়েছি ।
খবর পেয়ে আমি বাসায় গেলাম। আমাকে দেখেই তিনি কাঁধে হাত রেখে বললেন, আমার নাম নিম্মি। আর এটা আমার মেয়ে শাম্মি। ক্লাস সেভেনে পড়ে।
আপা চা দিলেন। চা খেতে খেতে তিনি বললেন,তুমি মাঝে মাঝে আমার বাসায় যাবা। তোমার দুলাভাই তো ভোরে অফিসে যায়। দুপুরে খেতে আসেন আধা ঘন্টার জন্য। বিকেলে স্কোয়াশ খেলেন। আমাদের বাসাটা পাহাড়ের উপরে। তুমি এলে বাসার বাইরে বাগানে বসে চা খেতে খেতে গান শুনবো। তোমার কাছে সুন্দর সুন্দর গান আছে ।
আমি কয়েকদিন নিম্মি আপার বাসায় গিয়েছিলাম। জিওসির বাসার কিছু পরেই উনাদের বাসা।
আমি গেলে উনি অনেক আদর করতেন। অনেক কিছু খাওয়াতেন। পাহারের উপরে একটাই বাসা। আশে পাশে কোনো বাসা নেই। মাঝে মাঝে নিম্মি আপা আমার হাত ধরে অনেকক্ষণ পশ্চিম দিকে পাহারের নিচে সবুজ ধান ক্ষেতের দিকে তাঁকিয়ে থাকতেন। আমি ভয়ে হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলে তিনি চাপ দিয়ে ধরে রাখতেন।
একদিন আমি বললাম,আপা, তোমার বাসায় হেঁটে উঠতে কষ্ট হয়। তোমরা তো আর্মির ল্যান্ড ক্রুইজার জিপে উঠে যাও তাই টের পাওনা। আপা বললেন,তুমি ক্যান্টনমেন্ট গেইটে এসে এমপিকে বলবে। দেখো এম,পি তোমাকে গাড়ি দিয়ে বাসায় দিয়ে যাবে। আমি ফোনে বলে দেবো।
শাম্মি আমাকে মামা ডাকতো। একদিন দুপুরে কর্নেল সাহেবের সঙ্গেই লাঞ্চ খেলাম।
প্রায় ছয়মাস আমি নিম্মি আপার হাত ধরে পাহারের উপর বসে থাকতাম। আপার ছোট ভাই বেলাল বেড়াতে এলেও কান্দিরপাড় আমার সঙ্গে সময় কাটাতো।
এক সময় তাদের ট্রান্সফার হয় চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে। যাওয়ার দুইদিন আগে আপা তাদের ব্যাটম্যানকে পাঠালেন আমাকে নিতে। আমার আপার বাসায় তখন টিএন্ডটি ফোন ছিলো না। আমি মাঝে মাঝে কোনো দোকান থেকে ফোন করতাম।
নিম্মি আপার বাসার এক্সটেনশন ছিলো ২৫৪। ফোন করলেই ক্যান্টনমেন্ট এক্সচেঞ্জ ধরে নাম পরিচয় জেনে কানেকশন দিতেন ২৫৪ এ। আমি আপার সঙ্গে অনেক কথা বলতাম।
ব্যাটম্যানের সঙ্গে বাসায় যাওয়ার পর আপা আমাকে একটা রুমে নিয়ে খাটে বসিয়ে আমার বাঁ গালে ছোট্ট করে একটা চুমু দিয়ে বলেছিলেন....
তোমাকে খুব মায়া লাগে। তুমি এতো দুষ্টু কেনো ? তোমার কথা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। তুমি আমাকে ভুলে যেওনা।
আমি নিম্মি আপাকে আজো ভুলিনি। ৩৬ বছর আগের নিম্মি আপা কি বেঁচে আছেন ? কোথায় যেন আছেন ? নিম্মি আপা তোমাকে এখনো ভুলিনি।
১১ নভেম্বর, ২০১৮
কুমিল্লা ।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আমার দেখা ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ

আমার দেখা ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ সরকারঃ শেখ মুজিবের শাসনামল ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের মার্চে শুরু হয়ে সেই বছরেরই ডিসেম্বরের দিকে গিয়ে শেষ হয়। এই দুর্ভিক্ষে অসংখ্য মানুষ অনাহারে মারা গিয়েছিল। এই দুর্ভিক্ষকে স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক হিসেবে গন্য করা হয়। ওই সময় আমি বুঝতাম। ক্লাশ ফোরে পড়তাম। আহারে ! কি যে অভাব ! অনেকের মতো আমরাও ভাত না খেয়ে রুটি খেয়েছি । তাও পরিমিত । কখনো জাউ খেয়েছি । শুকনো মরিচ পাওয়া যেতো না । কাঁচা মরিচের কেজি ছিলো ১৫০ টাকা । লবন ১২০ টাকা । আর সোনার ভরি ছিলো তখন ১৫০ টাকা । সোনা শুধু ওই সময় কম দাম ছিলো । চারদিকে অভাব । সারাদেশের মানুষের হাহাকার । কতো মানুষ না খেয়ে মারা গেছেন ! বিদেশি রিলিফ সব আওয়ামী লীগের লোকেরা চুরি করেছে । আর বেশিরভাগ রিলিফ সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে পাচার হয়েছিলো । তখন বর্ডার খোলা ছিলো তখন । মহিলাদের শাড়ি কাপড় ছিলো না । অনেকে মাছ ধরার জাল পরে লজ্জাস্থান ঢেকেছিলো । এসব ছবি পত্রিকায়ও ছাপা হয়েছিলো । কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতাদের কোনো অভাব ছিলো না । বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র দুই বছর তিন মাসের মাথায় ...

বোতল

বোতল মানব জীবনে বোতল অপরিহার্য । বোতল অনেক অর্থেও ব্যবহার হয় । কোনো কোনো এলাকায় আনস্মার্ট, বেয়াক্কেল প্রকৃতির লোককেও বোতল বলা হয় । ইউরোপ আমেরিকায় থাকতে আমি ডৃংক করতাম । হার্ড ডৃংক কমই খেতাম । প্রতিদিনই বিয়ার খেতাম । বিয়ার স্বাস্থ্য ভালো রাখে ও কাজ করতে এনার্জি জোগায় । পরিমিত বিয়ার খেলে কেউ মাতাল হয় না । মাঝে মাঝে বিশেষ কোনো পার্টিতে হুইস্কি খাওয়া হতো । তাও দামি ব্র্যান্ডের । জনি ওয়াকার ব্ল্যাক লেবেল, টিচার্স, পাসপোর্ট, হেনেসি, শিভাস রিগাল, জ্যাক ড্যানিয়েলস । সাকুরায়ও অনেক সময় এসব ব্র্যান্ডের হুইস্কি পাওয়া যায় না । তো দেশে আসার পরও কিছু দিন ডৃংক করেছিলাম । কুমিল্লায় সরকার অনুমোদিত একটা মদের দোকান আছে চক বাজারে । নামঃ নাদের ট্রেডিং কোং । এটা প্রায় আজ ৫০ বছর । এখানে বিদেশি ব্র্যান্ডের ডৃংক পাওয়া যায় না । দেশিয় কোম্পানি ‘কেরো এন্ড কোং’ যা দর্শনায় অবস্থিত তার তৈরি ভদকা, হুইস্কি, জিন পাওয়া যায় । আমাদের সমাজতো রক্ষনশীল । তাই কান্দিরপাড় থেকে একটা স্প্রাইট কিনে অর্ধেক খেতে খেতে চক বাজার যেতাম । নাদেরে যখন পৌঁছতাম তখন স্প্রাইটের বোতল অর্ধেক খালি হয়ে যেতো । আমি বাবুল ভাইকে স্প্...

অশ্লীল নাম

বাংলাদেশের কিছু প্রতিষ্ঠান ও স্থানের বিচিত্র বা বিকৃত অর্থের নাম যা পরিবর্তন করা উচিতঃ ১. বোদা মহিলা মহাবিদ্যালয়, বোদা, পঞ্চগড় ২. চুমাচুমি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রাঙ্গামাটি ৩. সোনাপোতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, খুলনা ৪. মানুষমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নীলফামারি ৫. সোনাকাটা ইউনিয়ন, তালতলী, বরগুনা ৬.বড়বাল ইউনিয়ন, মিঠাপুকুর, রংপুর ৭.সোনাখাড়া ইউনিয়ন, রায়গঞ্জ, সিরাজগঞ্জ ৮. ধনকামড়া গ্রাম, ভোদামারা, দিনাজপুর ৯.গোয়াকাটা, দোহার, ঢাকা ১০. গোয়াতলা, ময়মনসিংহ ১১.লেংটার হাট, মতলব, চাঁদপুর