আমেরিকান ভিক্ষুক
ভিক্ষুকের সামনে একটা এলুমিনিয়ামের থালা । তার পাশেই লেখা...
"দয়া করে কয়েন ফেলে শব্দ দূষণ করবেন না । নোট প্রদান করুন ।"
বিষয়টা অনেকের কাছে হাসির বা অবিশ্বাস্য মনে হলেও আমার কাছে সত্য মনে হয়েছে । আমি বিদেশে খুব ঘোরাঘুরি করতাম । সুযোগ পেয়ে বাঁদরামিও কম করিনি । ভিক্ষুক নিয়ে সবারই কম বেশি অভিজ্ঞতা আছে ।
আমেরিকার প্রায় সবকিছুই আমার ভালো লাগে একমাত্র তাদের সাম্রাজ্যবাদী ফরেন পলিসি ছাড়া । বাংলাদেশের কয়েকজন ভিক্ষুককে এক সময় আমি মারতেও চেষ্টা করেছিলাম । বিবেকের বাধায় মারতে পারিনি । ওরা ভীষণ বিরক্ত করে। সময় অসময় বুঝে না। সকালে বাসায় এসে ডোর বেল বাজিয়েও ডাকে অথচ আমি ঘুমে!
এক আমেরিকান ভিক্ষুকের সঙ্গেও আমার ঝগড়া হয়েছিলো । সেই কবে রবিবার এক বিকেলে ১৯৯৭ সালের সামারে । আমি নিউ ইয়র্কের ফিফথ এভিনিউ ধরে হাঁটছিলাম । অনেক নামি দামি লেখকরা তাদের লেখায় ফিফথ এভিনিউকে ( 5th Avenue ) পৃথিবীর বিখ্যাত রাস্তা বলে উল্লেখ করেছেন । ফিফথ এভিনিউর ফরটি সেকেন্ড স্টৃটের কোণায় নিউ ইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরি । অনেক বড় লাইব্রেরি । বিশাল বড় । সামনে পেছনে বিরাট লন। বিকেলে বসে সময় কাটাতে বেশ আনন্দময়।
সেই লাইব্রেরি থেকে স্বদেশ দা'কে ( স্বাদেশ রায় ওই সময় যায়যায়দিনের সহকারি সম্পাদক ছিলেন । তিনি এখন জনকণ্ঠে আছেন ।) একবার ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চের ওয়াশিংটন পোষ্ট পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠা পাঠিয়েছিলাম । যেখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সচিত্র খবর প্রকাশিত হয়েছিলো । স্বাদেশ দা লেখলেখির প্রয়োজনে ২৯ মার্চ ১৯৭১ সালের ওয়াশিংটন পোষ্ট পত্রিকার প্রথম পাতার রিপোর্ট চেয়ে আমাকে অনুরোধ করেছিলেন । সে কথা আরেকদিন । আজ আমেরিকান ফকিরের কথা লিখি ।
তো ফর্টি সেকেন্ড(42nd) স্টৃটের কোণায় একজন ভিক্ষুক একটা ফোল্ডিং চেয়ারে বসেছিলো । জোয়ান ভিক্ষুক । তার পরনে ব্লু রঙের জিন্স প্যান্ট । গায়ে সাদা রঙের টি শার্ট । টি শার্টের বুকে লাল রঙে লেখা I Love New York . মাথায় কাউবয় ক্যাপ । চোখে সানগ্লাস । পায়ে সাদা রঙের ক্যাডস । তার পাশে একটা ছোট প্লে কার্ড ।
লেখা –
I am Homeless . Help Me . Thank You.
পাশে দিয়ে যে-ই যায় তাকেই সে বোল্ডলি বলে Give Me a Dollar Man . I Need a Beer . আমি কাছে আসতেই সে জোরে বললো -Give Me a Dollar Man . I Need a Beer । যেনো সে আমার কাছে টাকা পায়! বাংলাদেশ হলে আমি তাকে মারতাম । আমেরিকা এমন দেশ ভিক্ষুক মারলেও জেলে যেতে হবে । আমিও কিছুটা জোরেই উত্তর দিলাম- I Don't have Man .
ওমা ! আমি একটু দূরে যেতেই সে পেছন থেকে চিৎকার করে বললো- You Liar Man . I know you have. আমি দাঁড়ালাম । মনে কষ্ট পেলাম । সে আমাকে সরাসরি বলছে - তুমি মিথ্যুক । আমি জানি তোমার কাছে টাকা আছে আর তুমি বলছো নাই ! আমি ভিক্ষুকের কাছে এসে তার নাম জানতে চাইলাম । সে বললো পিটার । আমি বললাম,
তুমি আমাকে মিথ্যাবাদী বললে কেনো ? সে তর্ক করে বললো- তোমার কাছে টাকা আছে আর তুমি বলছো নাই ! সে জোর দিয়ে বললো Is it not a Lie ? আমি বললাম, আছে কিন্তু তোমাকে দেবো না । সে আমাকে গালি দিয়ে বললো Fuck You Man । রীতিমত সে আমাকে গালাগালি শুরু করেছে ! আমি বললাম, তোমার কি চাই ? সে এবার নরম সুরে বললো- Give Me One Beer Man . You know I need It. আমাকে একটা বিয়ার দাও । তুমি জানো আমার এটা দরকার ।
আমার মন দ্রবীভূত হলো । তাকে বললাম, Come On .Let’s drink together . এসো। দু'জন এক সঙ্গে বিয়ার খাবো।
সে উঠে চেয়ারটা ফোল্ড করে আমার সঙ্গে এলো । পাশেই একটা বারে আমি আর ভিক্ষুক ঢুকলাম । তাকে বললাম, তুমি আজ যত মদ খাবে সব বিল আমি দেবো । সে অনেক দুঃখের কথা বললো । তার বাড়ি অ্যারিজোনা । জীবনের প্রতি তার কোনো আগ্রহ নেই । অনেকেরই মনে থাকার কথা, ক্লিনটনের প্রেসিডেন্সির সময় একবার ৪০ জন যুবক ক্যালিফোর্নিয়ায় একসঙ্গে আত্মহত্যা করেছিলো । তাদের কোনো দাবি ছিলো না । আত্মহত্যার নোটে তারা লিখেছিলেন -
এ জীবন তাদের ভালো লাগে না । তাই তারা আত্মহত্যা করেছে । এ নিয়ে বিল ক্লিনটন জাতির উদ্দেশে টিভিতে ভাষণও দিয়েছিলেন । আমি ভাবলাম, ভিক্ষুক পিটারকেও বোধহয় এই রোগে পেয়েছে । রাত ১০টায় বিয়ার খাওয়া শেষে বিল দিয়ে বার থেকে বের হয়ে আমি তাকে আরো বিশ ডলার দিতে চাইলে সে নেয়নি । বললো, I don’t need man . It’s enough . I thank you.
আমাকে গুড নাইট বলে সে হুইটনি হিউস্টনের 'I will always love you' আমি চিরকালই তোমাকে ভালোবাসবো গানটি গাইতে গাইতে চলে গেলো ।
©Karim Chowdhury
29 April, 2020
Cumilla.
ভিক্ষুকের সামনে একটা এলুমিনিয়ামের থালা । তার পাশেই লেখা...
"দয়া করে কয়েন ফেলে শব্দ দূষণ করবেন না । নোট প্রদান করুন ।"
বিষয়টা অনেকের কাছে হাসির বা অবিশ্বাস্য মনে হলেও আমার কাছে সত্য মনে হয়েছে । আমি বিদেশে খুব ঘোরাঘুরি করতাম । সুযোগ পেয়ে বাঁদরামিও কম করিনি । ভিক্ষুক নিয়ে সবারই কম বেশি অভিজ্ঞতা আছে ।
আমেরিকার প্রায় সবকিছুই আমার ভালো লাগে একমাত্র তাদের সাম্রাজ্যবাদী ফরেন পলিসি ছাড়া । বাংলাদেশের কয়েকজন ভিক্ষুককে এক সময় আমি মারতেও চেষ্টা করেছিলাম । বিবেকের বাধায় মারতে পারিনি । ওরা ভীষণ বিরক্ত করে। সময় অসময় বুঝে না। সকালে বাসায় এসে ডোর বেল বাজিয়েও ডাকে অথচ আমি ঘুমে!
এক আমেরিকান ভিক্ষুকের সঙ্গেও আমার ঝগড়া হয়েছিলো । সেই কবে রবিবার এক বিকেলে ১৯৯৭ সালের সামারে । আমি নিউ ইয়র্কের ফিফথ এভিনিউ ধরে হাঁটছিলাম । অনেক নামি দামি লেখকরা তাদের লেখায় ফিফথ এভিনিউকে ( 5th Avenue ) পৃথিবীর বিখ্যাত রাস্তা বলে উল্লেখ করেছেন । ফিফথ এভিনিউর ফরটি সেকেন্ড স্টৃটের কোণায় নিউ ইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরি । অনেক বড় লাইব্রেরি । বিশাল বড় । সামনে পেছনে বিরাট লন। বিকেলে বসে সময় কাটাতে বেশ আনন্দময়।
সেই লাইব্রেরি থেকে স্বদেশ দা'কে ( স্বাদেশ রায় ওই সময় যায়যায়দিনের সহকারি সম্পাদক ছিলেন । তিনি এখন জনকণ্ঠে আছেন ।) একবার ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চের ওয়াশিংটন পোষ্ট পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠা পাঠিয়েছিলাম । যেখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সচিত্র খবর প্রকাশিত হয়েছিলো । স্বাদেশ দা লেখলেখির প্রয়োজনে ২৯ মার্চ ১৯৭১ সালের ওয়াশিংটন পোষ্ট পত্রিকার প্রথম পাতার রিপোর্ট চেয়ে আমাকে অনুরোধ করেছিলেন । সে কথা আরেকদিন । আজ আমেরিকান ফকিরের কথা লিখি ।
তো ফর্টি সেকেন্ড(42nd) স্টৃটের কোণায় একজন ভিক্ষুক একটা ফোল্ডিং চেয়ারে বসেছিলো । জোয়ান ভিক্ষুক । তার পরনে ব্লু রঙের জিন্স প্যান্ট । গায়ে সাদা রঙের টি শার্ট । টি শার্টের বুকে লাল রঙে লেখা I Love New York . মাথায় কাউবয় ক্যাপ । চোখে সানগ্লাস । পায়ে সাদা রঙের ক্যাডস । তার পাশে একটা ছোট প্লে কার্ড ।
লেখা –
I am Homeless . Help Me . Thank You.
পাশে দিয়ে যে-ই যায় তাকেই সে বোল্ডলি বলে Give Me a Dollar Man . I Need a Beer . আমি কাছে আসতেই সে জোরে বললো -Give Me a Dollar Man . I Need a Beer । যেনো সে আমার কাছে টাকা পায়! বাংলাদেশ হলে আমি তাকে মারতাম । আমেরিকা এমন দেশ ভিক্ষুক মারলেও জেলে যেতে হবে । আমিও কিছুটা জোরেই উত্তর দিলাম- I Don't have Man .
ওমা ! আমি একটু দূরে যেতেই সে পেছন থেকে চিৎকার করে বললো- You Liar Man . I know you have. আমি দাঁড়ালাম । মনে কষ্ট পেলাম । সে আমাকে সরাসরি বলছে - তুমি মিথ্যুক । আমি জানি তোমার কাছে টাকা আছে আর তুমি বলছো নাই ! আমি ভিক্ষুকের কাছে এসে তার নাম জানতে চাইলাম । সে বললো পিটার । আমি বললাম,
তুমি আমাকে মিথ্যাবাদী বললে কেনো ? সে তর্ক করে বললো- তোমার কাছে টাকা আছে আর তুমি বলছো নাই ! সে জোর দিয়ে বললো Is it not a Lie ? আমি বললাম, আছে কিন্তু তোমাকে দেবো না । সে আমাকে গালি দিয়ে বললো Fuck You Man । রীতিমত সে আমাকে গালাগালি শুরু করেছে ! আমি বললাম, তোমার কি চাই ? সে এবার নরম সুরে বললো- Give Me One Beer Man . You know I need It. আমাকে একটা বিয়ার দাও । তুমি জানো আমার এটা দরকার ।
আমার মন দ্রবীভূত হলো । তাকে বললাম, Come On .Let’s drink together . এসো। দু'জন এক সঙ্গে বিয়ার খাবো।
সে উঠে চেয়ারটা ফোল্ড করে আমার সঙ্গে এলো । পাশেই একটা বারে আমি আর ভিক্ষুক ঢুকলাম । তাকে বললাম, তুমি আজ যত মদ খাবে সব বিল আমি দেবো । সে অনেক দুঃখের কথা বললো । তার বাড়ি অ্যারিজোনা । জীবনের প্রতি তার কোনো আগ্রহ নেই । অনেকেরই মনে থাকার কথা, ক্লিনটনের প্রেসিডেন্সির সময় একবার ৪০ জন যুবক ক্যালিফোর্নিয়ায় একসঙ্গে আত্মহত্যা করেছিলো । তাদের কোনো দাবি ছিলো না । আত্মহত্যার নোটে তারা লিখেছিলেন -
এ জীবন তাদের ভালো লাগে না । তাই তারা আত্মহত্যা করেছে । এ নিয়ে বিল ক্লিনটন জাতির উদ্দেশে টিভিতে ভাষণও দিয়েছিলেন । আমি ভাবলাম, ভিক্ষুক পিটারকেও বোধহয় এই রোগে পেয়েছে । রাত ১০টায় বিয়ার খাওয়া শেষে বিল দিয়ে বার থেকে বের হয়ে আমি তাকে আরো বিশ ডলার দিতে চাইলে সে নেয়নি । বললো, I don’t need man . It’s enough . I thank you.
আমাকে গুড নাইট বলে সে হুইটনি হিউস্টনের 'I will always love you' আমি চিরকালই তোমাকে ভালোবাসবো গানটি গাইতে গাইতে চলে গেলো ।
©Karim Chowdhury
29 April, 2020
Cumilla.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন