জহির রায়হান

 জহির রায়হান

বাংলা চলচ্চিত্রের নামকরা পরিচালক জহির রায়হান। জহির রায়হান স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতেন। স্বপ্ন দেখতেন এদেশকে সমাজতান্ত্রিক রাস্ট্র বানাবেন। সমাজতন্ত্রের মহান (!) আদর্শ বাস্তবায়ন করবেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম এবং সহজাত পরিহাস দেশ যখন তার চাওয়ামত স্বাধীন হলো তখন স্বাধীন বাংলাদেশেই ‘গুম’ হওয়া ব্যক্তি হয়ে গেলেন তিনি স্বয়ং। অর্থাৎ জহির রায়হানকে দিয়েই স্বাধীন (!) বাংলাদেশে গুমের মতো একটি জঘন্য রাজনৈতিক চক্রান্তের সফল অভিষেক হয়।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর জহির রায়হান আগরতলা হয়ে কলকাতায় চলে যান। নিজেকে যুক্ত করেন মুক্তিযুদ্ধের প্রচার কাজ সংগঠিত করার কাজে এবং পাকিস্থানের গণহত্যা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার জন্য ‘’স্টপ জেনোসাইড" নামের একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো যুদ্ধে শরণার্থী শিবিরে মানুষের দুর্দশার চিত্র, কলকাতায় পালিয়ে যাওয়া বড় বড় নেতাদের আরাম আয়েশের চিত্র তুলতে গিয়ে জহির রায়হান মুজিবনগর সরকারের রোষানলে পড়েছিলেন। সাধারন মানুষদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করার অমানুষিক পরিশ্রমের অনেক চিত্র তিনি জীবন বাজি রেখে ধারন করেছিলেন । ‘

"স্টপ জেনোসাইড" ছবিটি নির্মাণের সময় আওয়ামী লীগের নেতারা তাঁকে নানাভাবে বাধা দিয়েছে। বিভিন্ন সেক্টরে শুটিং করতে দেয় নি, এমন কি কোন কোন সেক্টরে তাঁর গমন পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল। আওয়ামী লীগের নেতারা ছবি দেখে ছাড়পত্র না দেয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সেন্সর বোর্ডকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তথ্যসূত্র : একুশে ফেব্রুয়ারী / জহির রায়হান (ভূমিকা : শাহরিয়ার কবির) ॥ [ পল্লব পাবলিশার্স - আগস্ট, ১৯৯২ । পৃ: ১৩-১৬ ]

‘স্টপ জেনোসাইড’ মুক্তি দেয়ার প্রতিবাদে ১০ই সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে কলকাতায় বসবাসরত আওয়ামী সমর্থিত বুদ্ধিজীবী ও ‘সন অব পাকিস্থান’ চলচ্চিত্রের পরিচালক ফজলুল হক ( চ্যানেল আইয়ের ফরিদুর রেজা সাগর ও কেকা ফেরদৌসীর বাবা) অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের কাছে একটি চিঠি লিখেন যেখানে প্রামাণ্য চিত্রটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে/ বন্ধের ব্যাপারে অনুরোধ জানিয়েছিলেন।( সম্পূর্ণ চিঠিটা ছাপা আছে - বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস ও দলিলপত্র (৩য় খন্ড, পাতা ১২৭-১২৮), তথ্য মন্ত্রণালয়, গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। প্রথম প্রকাশ - নভেম্বর ১৯৮২।)

বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর জহির রায়হান ঢাকায় ফিরে আসেন। ফিরে এসেই শুনলেন তার অগ্রজ শহীদুল্লাহ কায়সার ১৪ ডিসেম্বর থেকে নিখোঁজ। তার উদ্যোগে বেসরকারি বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডসহ অন্যান্য ঘটনার প্রচুর প্রমাণাদি তিনি সংগ্রহ করেন এবং ১৯৭২ সালের ২৫ জানুয়ারী ঢাকা প্রেসক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করেন যে, তার সংগৃহীত প্রমাণাদি প্রকাশ করলেই অনেকের কুকীর্তি ফাঁস হয়ে যাবে। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে ভারতের মাটিতে আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকান্ড, বিভিন্ন হোটেলে বিলাসবহুল ও আমোদ-ফুর্তিময় জীবনযাপন, রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষ আওয়ামী আদর্শে বিশ্বাসহীন বাঙালিদের নির্মূল করার ষড়যন্ত্র প্রভৃতির প্রামাণ্য দলিল জহির রায়হান কলকাতা থাকাকালে সংগ্রহ করেছিলেন। বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারের নিখোঁজ ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের ঘটনাবলী তাকে বিচলিত করে। এসব ঘটনা তাঁর পূর্বেকার রাজনৈতিক বিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দেয়।

১৯৭২ সালের ২৫ জানুয়ারি সাংবাদিক সম্মেলনের কয়েকদিন পর ৩০ জানুয়ারি রোববার সকালে রফিক নামের এক ব্যক্তির অজ্ঞাত টেলিফোন আসে জহির রায়হানের কায়েতটুলির বাসায়। রফিক ছিলেন জহিরের পূর্ব পরিচিত যিনি ইউসিসে চাকরি করতেন । প্রথমে ফোন ধরেছিলেন জহির রায়হানের ছোট বোন ডাক্তার সুরাইয়া যার কাছে জহিরকে খোঁজা হচ্ছিল । সুরাইয়া জহির রায়হানকে ডেকে ফোন ধরিয়ে দেয় । টেলিফোনে জহিরকে বলা হয়েছিল, আপনার বড়দা মিরপুর ১২ নম্বরে বন্দী আছেন। যদি বড়দাকে বাঁচাতে চান তাহলে এক্ষুণি মিরপুর চলে যান। একমাত্র আপনি গেলেই তাকে বাঁচাতে পারবেন। টেলিফোন পেয়ে জহির রায়হান দুটো গাড়ী নিয়ে মিরপুরে রওনা দেন। তাঁর সাথে ছিলেন ছোট ভাই মরহুম জাকারিয়া হাবিব, চাচাত ভাই শাহরিয়ার কবির, বাবুল ( ২য় স্ত্রী সুচন্দার ভাই), আব্দুল হক (পান্না কায়সারের ভাই), নিজাম ও পারভেজ। মিরপুর ২নং সেকশনে পৌছার পর সেখানে অবস্থানরত ভারতীয় সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) এবং পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে জহির রায়হানের টয়োটা গাড়ি (ঢাকা-ক-৯৭৭১) সহ থাকতে বলে অন্যদের ফেরত পাঠিয়ে দেন। শাহরিয়ার কবির অন্যদের সাথে করে বাড়ী ফিরে আসেন । এভাবেই জহির চিরতরে হারিয়ে যায়। অথচ সেদিন বিকেলেই প্রেসক্লাবে তাঁর কাছে থাকা অনেক দুর্লভ তথ্য প্রমান ফাঁস করার কথাছিল যা ফাঁস হলে অনেকের মুখোশ উম্মোচিত হয়ে যেতো যা আর কোনদিন করা হলো না ।
জহীর রায়হানকে টেলিফোন করেছিল যে রফিক, তাকে নিয়ে যখন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি শুরু হলো। তখন তাকে নাগরিকত্ব দিয়ে পুরো পরিবারসহ আমেরিকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। এই ঘটনা জহিরের নিখোঁজ হওয়ার সম্পর্কে রফিকের ভূমিকাকে আরো সন্দেহযুক্ত করে তোলে। (সুত্রঃ দৈনিক আজকের কাগজ ৮ ডিসেম্বর ১৯৯৩)

*আরো তথ্য সুত্র - মুক্তিযুদ্ধ : আগে ও পরে / পান্না কায়সার (আগামী প্রকাশনী - ফেব্রুয়ারী, ১৯৯১ । পৃ: ১৬৮)