সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

‘দৃষ্টিপাত’

‘দৃষ্টিপাত’

“শুক্লপক্ষের অষ্টমীর চাঁদ উঠেছে মেঘশূন্য আকাশে,তার জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়েছে দু’পাশের বাংলোগুলোর বিস্তীর্ণ অঙ্গনে। পথ জনশূন্য, ধ্বনিবিরল, কাছাকাছি কোথায় যেন হাসনুহানার ঝাড়ে ফুটেছে ফুল। তার তীব্র মদির সুবাসে বাতাস হয়েছে উতলা আকুল, রজনী হয়েছে গন্ধবিহ্বল।
চলতে চলতে ভাবছিলেম, আধারকারের কথা। কানে বাজতে লাগলো সকরুণ স্বীকারোক্তি,
“মিনি সাহেব, আমি ইডিয়টই বটে! পরিহাসকে মনে করেছি প্রেম; খেলাকে ভেবেছি সত্য কিন্তু আমিতো একা নই। জগতে আমার মতো মূর্খরাই তো জীবনকে করেছে বিচিত্র; সুখে দুঃখে অনন্ত মিশ্রিত। যুগে যুগে নির্বোধ হতভাগ্যের দল ভুল করেছে, ভালোবেসেছে, তারপর সারাদিনভর কেঁদেছে। হৃদয়নিংড়ানো অশ্রুধারায় সংসারকে করেছে রসঘন, পৃথিবীকে করেছে কমনীয়। এদের ভুল, ত্রুটি, বুদ্ধিহীনতা নিয়ে কবি রচনা করেছেন কাব্য, সাবুক বেঁধেছেন গান, শিল্পী অঙ্কন করেছেন চিত্র, ভাস্কর পাষাণ–খণ্ডে উৎকীর্ণ করেছেন অপূর্ব সুষম। জগতে বুদ্ধিমানেরা করবে চাকরি, বিবাহ, ব্যাংকে জমাবে টাকা, স্যাকরার দোকানে গড়াবে গহনা; স্ত্রী, পুত্র, স্বামী, কন্যা নিয়ে নির্বিগ্ন জীবন যাপন করবে স্বচ্ছন্দ সচ্ছলতায়। তবু আমরা মেধাহীনদের একদল একথা কোনদিন মানবো না যে,সংসারে যে বঞ্চনা করলো, হৃদয় নিয়ে করলো ব্যঙ্গ, দুধ বলে দিলো পিটুলী,- তারই হলো জিত, আর ঠকলো কেবল সে, যে উপহাসের পরিবর্তে দিলো প্রেম।
অতি দুর্বল শান্তনা । বুদ্ধি দিয়ে রবি ঠাকুরের কবিতা আবৃতি করে বলা সহজ-“ জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা, ধুলায় তাদের যত হোক অবহেলা।” কিন্তু জীবনতো মানুষের সম্পর্ক বিবর্জিত একটা তর্ক মাত্র নয় । শুধু কথা গেঁথে গেঁথে ছন্দ রচনা করা যায়, জীবন ধারন করা যায় না।
আধারকার হচ্ছেন সেই শ্রেণীর পুরুষ, যারা কিছুই হাতে রাখতে জানেন না। এদের কপালে দুঃখ অনিবার্য। পলিটিক্সসের মতো মানুষের জীবনও হচ্ছে অ্যাডজাস্টমেন্ট আর কম্প্রোমাইজ। এ দারুণ ইনফ্লেশনের বাজারেও সংসারে হৃদয়ের দাম খুব বেশি নয়।
সুনন্দার পক্ষে সম্ভব ছিলো না আধারকারের গতিতে তাল রেখে চলা। সে নারী, প্রেম তার পক্ষে একটা সাধারণ ঘটনা মাত্র। আবিস্কার নয়, যেমন পুরুষের কাছে। মেয়েরা স্বভাবত সাবধানী,তাই প্রেমে পড়ে তারা ঘর বাঁধে। ছেলেরা স্বভাবত বেপরোয়া, তাই প্রেমে পড়ে তারা ঘর ভাঙে। প্রেম মেয়েদের কাছে একটা প্রয়োজন, সেটা আটপৌরে শাড়ির মতোই সাধারণ; তাতে না আছে উল্লাস, না আছে বিস্ময়, না আছে উচ্ছলতা। ছেলেদের পক্ষে প্রেম জীবনের দুর্লভ বিলাস, গরিবের ঘরে বেনারসি শাড়ির মতো ঐশ্বর্যময়, যে পায় সে অনেক দাম দিয়েই পায়। তাই প্রেমে পড়ে পুরুষেরাই করতে পারে দুরূহ ত্যাগ এবং দুঃসাধ্যসাধন।
আধারকার নিজেই একদিন বলেছিলেন, মিনি সাহেব, “জগতে যুগে যুগে কিং এডওয়ার্ডরাই করেছে মিসেস সিম্পসনের জন্য রাজ্য বর্জন, প্রিন্সেস এলিজাবেথরা করেনি কোনো জন, স্মিথ বা ম্যাকেঞ্জির জন্য সামান্যতম ত্যাগ। বিবাহিতা নারীকে ভালোবেসে সর্বদেশে সর্বকালে আজীবন নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়েছে একাধিক পুরুষ; পরের স্বামীর প্রেমে পড়ে কোনোদিন কোনো নারী রয়নি চিরকুমারী”।
কোমল হৃদয় বলে আমার খ্যাতি নেই । কিন্তু আধারকারের জন্য সত্যি বেদনাবোধ করলেম হৃদয়ে। সুনন্দা ব্যানার্জী আজ কোথায় আছেন জানি নে। অনুমান করছি,এতোদিনে তার যৌবন হয়েছে গত, দেহ বিগতশ্রী, দৃষ্টি বিদ্যুৎহীন, এবং কপালের রেখাগুলি প্রচুর প্রসাধন প্রলেপের দ্বারাও আজ আর কোনমতেই গোপনসাধ্য নয়। কোনোদিন কোনো অবকাশ মুহুর্তে বহুবর্ষ আগেকার এক মারাঠি ব্রাহ্মণের চরম নির্বুদ্ধিতার কথা স্মরণ করে ক্ষনিকের জন্য হলেও তাঁর মন উন্মনা হয় কিনা, সে কথা আজ আর জানার উপায় নেই অথচ তাঁরই জন্য আধারকার দিলেন চরম মূল্য। নিজেকে বঞ্চিত করলেন সাফল্য থেকে, খ্যাতি থেকে, ঐহিকের সর্ববিদ সুখ স্বাচ্ছন্দ্য থেকে সব চেয়ে বড় কথা, নিজেকে বঞ্চিত করলেন সম্ভবপর উত্তরপুরুষ থেকে, বংশের ধারাকে করলেন বিলুপ্ত। কোনোদিন সন্ধ্যাবেলায় তাঁর কুশল কামনা করে তুলশীমঞ্চে কেউ জ্বালাবে না দীপ, কোনো নারী সীমান্তে ধরবে না তাঁর কল্যাণ-কামনায় সিন্দুর চিহ্ন, প্রবাসে অদর্শনবেদনায় কোনো চিত্ত হবে না উদাস উতল। রোগশয্যায় ললাটে ঘটবে না কারো উদ্বেগকাতর হস্তের সুখস্পর্শ, কোনো কপোল থেকে গড়িয়ে পড়বে না নয়নের উদ্বেল অশ্রুবিন্দু। সংসার থেকে যেদিন হবেন অপসৃত, কোনো পীড়িত হৃদয়ে বাজবে না এতোটুকু ব্যথা, কোনো মনে রইবে না ক্ষীণতম স্মৃতি।

প্রেম জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য, মৃত্যুকে দেয় মহিমা। কিন্তু প্রবঞ্চিতকে দেয় কী? তাকে দেয় দাহ। যে আগুন আলো দেয় না অথচ দহন করে, সেই দীপ্তিহীন অগ্নির নির্দয় দহনে পলে পলে দগ্ধ হলেন কাণ্ডজ্ঞানহীন চারুদত্ত আধারকার।"
( আমি যখন ক্লাশ টেনে পড়তাম তখন একদিন আমার বড় আপার বাসায় কয়েকজন সিনিয়র আত্নীয় আমার রুমে বসে গল্প করছিলেন। তারা একটা বই হাতে নিয়ে পরস্পরকে দেখিয়ে বলতেন, “দেখেন, কি লিখেছেন এই ভদ্রলোক এই বইতে’! আমি পড়ার টেবিল থেকে তাদের কথা শুনতাম মনোযোগ দিয়ে। তারা যাযাবর এর ‘দৃষ্টিপাত’ উপন্যাস নিয়েই কথাগুলো বলেছিলেন। আমি কয়েকদিন পর বইটা কিনে পড়ে কিছুই বুঝি নি। সাধু ভাষায় লেখা কঠিন বাংলায় এই বই কলেজে উঠে পড়ে তবেই বুঝেছি। মাত্র ৯৬ পৃষ্ঠার এই ছোট উপন্যাসটি ৬০ দশকের এক সারাজাগানো প্রেমের উপন্যাস। এই বইয়ের অনেক কথা আজো মানুষ প্রেমের আলোচনায় উদ্বৃতি দেয়। আজো মাঝে মাঝে এই উপন্যাস আমি পড়ি। আমার জীবনের সঙ্গে এই উপন্যাসের কিছু মিল আছে। এই উপন্যাসের শেষের সোয়া পৃষ্ঠা এখানে লিখলাম।)
Karim Chowdhury
24 August, 2020
Cumilla.

Image may contain: indoor

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আমার দেখা ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ

আমার দেখা ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ সরকারঃ শেখ মুজিবের শাসনামল ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের মার্চে শুরু হয়ে সেই বছরেরই ডিসেম্বরের দিকে গিয়ে শেষ হয়। এই দুর্ভিক্ষে অসংখ্য মানুষ অনাহারে মারা গিয়েছিল। এই দুর্ভিক্ষকে স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক হিসেবে গন্য করা হয়। ওই সময় আমি বুঝতাম। ক্লাশ ফোরে পড়তাম। আহারে ! কি যে অভাব ! অনেকের মতো আমরাও ভাত না খেয়ে রুটি খেয়েছি । তাও পরিমিত । কখনো জাউ খেয়েছি । শুকনো মরিচ পাওয়া যেতো না । কাঁচা মরিচের কেজি ছিলো ১৫০ টাকা । লবন ১২০ টাকা । আর সোনার ভরি ছিলো তখন ১৫০ টাকা । সোনা শুধু ওই সময় কম দাম ছিলো । চারদিকে অভাব । সারাদেশের মানুষের হাহাকার । কতো মানুষ না খেয়ে মারা গেছেন ! বিদেশি রিলিফ সব আওয়ামী লীগের লোকেরা চুরি করেছে । আর বেশিরভাগ রিলিফ সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে পাচার হয়েছিলো । তখন বর্ডার খোলা ছিলো তখন । মহিলাদের শাড়ি কাপড় ছিলো না । অনেকে মাছ ধরার জাল পরে লজ্জাস্থান ঢেকেছিলো । এসব ছবি পত্রিকায়ও ছাপা হয়েছিলো । কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতাদের কোনো অভাব ছিলো না । বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র দুই বছর তিন মাসের মাথায় ...

বোতল

বোতল মানব জীবনে বোতল অপরিহার্য । বোতল অনেক অর্থেও ব্যবহার হয় । কোনো কোনো এলাকায় আনস্মার্ট, বেয়াক্কেল প্রকৃতির লোককেও বোতল বলা হয় । ইউরোপ আমেরিকায় থাকতে আমি ডৃংক করতাম । হার্ড ডৃংক কমই খেতাম । প্রতিদিনই বিয়ার খেতাম । বিয়ার স্বাস্থ্য ভালো রাখে ও কাজ করতে এনার্জি জোগায় । পরিমিত বিয়ার খেলে কেউ মাতাল হয় না । মাঝে মাঝে বিশেষ কোনো পার্টিতে হুইস্কি খাওয়া হতো । তাও দামি ব্র্যান্ডের । জনি ওয়াকার ব্ল্যাক লেবেল, টিচার্স, পাসপোর্ট, হেনেসি, শিভাস রিগাল, জ্যাক ড্যানিয়েলস । সাকুরায়ও অনেক সময় এসব ব্র্যান্ডের হুইস্কি পাওয়া যায় না । তো দেশে আসার পরও কিছু দিন ডৃংক করেছিলাম । কুমিল্লায় সরকার অনুমোদিত একটা মদের দোকান আছে চক বাজারে । নামঃ নাদের ট্রেডিং কোং । এটা প্রায় আজ ৫০ বছর । এখানে বিদেশি ব্র্যান্ডের ডৃংক পাওয়া যায় না । দেশিয় কোম্পানি ‘কেরো এন্ড কোং’ যা দর্শনায় অবস্থিত তার তৈরি ভদকা, হুইস্কি, জিন পাওয়া যায় । আমাদের সমাজতো রক্ষনশীল । তাই কান্দিরপাড় থেকে একটা স্প্রাইট কিনে অর্ধেক খেতে খেতে চক বাজার যেতাম । নাদেরে যখন পৌঁছতাম তখন স্প্রাইটের বোতল অর্ধেক খালি হয়ে যেতো । আমি বাবুল ভাইকে স্প্...

অশ্লীল নাম

বাংলাদেশের কিছু প্রতিষ্ঠান ও স্থানের বিচিত্র বা বিকৃত অর্থের নাম যা পরিবর্তন করা উচিতঃ ১. বোদা মহিলা মহাবিদ্যালয়, বোদা, পঞ্চগড় ২. চুমাচুমি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রাঙ্গামাটি ৩. সোনাপোতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, খুলনা ৪. মানুষমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নীলফামারি ৫. সোনাকাটা ইউনিয়ন, তালতলী, বরগুনা ৬.বড়বাল ইউনিয়ন, মিঠাপুকুর, রংপুর ৭.সোনাখাড়া ইউনিয়ন, রায়গঞ্জ, সিরাজগঞ্জ ৮. ধনকামড়া গ্রাম, ভোদামারা, দিনাজপুর ৯.গোয়াকাটা, দোহার, ঢাকা ১০. গোয়াতলা, ময়মনসিংহ ১১.লেংটার হাট, মতলব, চাঁদপুর