-----------------------------------------------
কয়েকদিন আগে শহরের এক জুনিয়র বন্ধু অনুরোধ করে বললো, তার এক আত্নীয়ের জন্য পাত্রী দেখতে যাবে আজ মঙ্গলবার। আমি তাদের সঙ্গে গেলে একটু ভালো হয়। জানতে চাইলাম কোথায়? জুনিয়র বন্ধু বললো, সোনাইমুড়ি। আমি অবাক হয়ে বললাম, নোয়াখালী! সে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
আমার অভিজ্ঞতা থেকে বললাম, কিছু ব্যতিক্রম বাদে নোয়াখালী, চট্রগ্রাম ও সিলেট জেলার অভিভাবকরা তাদের মেয়েদের অন্য জেলায় বিয়ে দেয় না। সে আমাকে জানালো, তাদের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের মাধ্যমে প্রপোজাল এসেছে। তাই তারা মেয়ে দেখতে ইচ্ছুক। ছেলেটি আমেরিকা প্রবাসী। জানতে চাইলাম সেখানে আমার কাজ কি? জুনিয়র বন্ধু বললো, আপনিও মেয়েকে দুই একটা প্রশ্ন করবেন। আমি নির্দ্বিধায় বললাম, বিয়ে হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও আমাকে নিলে পাত্রীপক্ষ আর বিয়ে দেবে না। আমাকে দয়া করে মাফ করো। আমি চাই বিয়েটা হোক। আর তুমি ভালো করেই জানো, আমার ব্যক্তিত্ব অভিভাবক শ্রেণীর মতো নয়। আমি নিজেই এখনো ছেলেমানুষ। সে হেসে বললো, এই জন্যই তো আপনাকে দরকার।
মেয়েটি চট্রগ্রাম ভার্সিটি থেকে পলিটিক্যাল সাইন্সে মাস্টার্স করেছে বলে আমাকে জানিয়ে সে খুব অনুরোধ করলো তাদের সঙ্গে যেতে। শেষমেশ রাজি হলাম। আজ সকাল নয়টায় তাদের গাড়িতে যেতে যেতে ভাবলাম, জীবনে কোনো দিন নোয়াখালী যাইনি। বেশিরভাগ নোয়াখালীর লোকেরা কুমিল্লার মানুষ পছন্দ করে না। যদিও বিদেশে আমার অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো, আছে নোয়াখালীর। বিদেশে জেলার চেয়ে দেশ বড় হয়ে যায়। আমি বা আপনি কোন জেলার সেটা বড় নয়। আমরা বাংলাদেশের সেটাই বড়। ইউরোপ- আমেরিকায় গেলে মানুষের মনও বড় হয়। দৃস্টি হয় প্রসারিত। যা দেশে দেখা যায় না। দুই তিন বছর আগে ফেসবুকে আমার বেশ কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো নোয়াখালীর। তাদের বেশিরভাগই চাটখিলের।
মিসেস তাসলিমা সুলতানা খানম, মিসেস নাসিমা সুলতানা, মিসেস মাফরুয়া হাসান পর্ণী, মিসেস কাবেরী মির্জা, মি.মির্জা মামুন, মি.জাভেদ কায়েস আরিয়ান, মি.সাহিদুল ইসলাম শাওনসহ আরো অনেকেই। তাদের সকলকেই আমি ভালোবাসতাম, সম্মানের চোখে দেখতাম। বিশেষ করে কাবেরী/মামুনের সঙ্গে তো আমার প্রাণের সম্পর্ক ছিলো। ছিলো পারিবারিক সম্পর্ক। ব্যক্তিগতভাবেও আমরা পরিচিত ছিলাম। কাবেরী ঢাকা-চাটখিল আসা যাওয়ার পথে কয়েকবার আমাকে খাবার দিয়ে গেছে আমার বাসায় এসে। সঙ্গে তার স্বামী মামুনও ছিলো। সেই মধুর সম্পর্কও থাকেনি। কোনো কারন ছাড়া তারাই দূরে সরে গেছে। অনুমান করি, মামুন হয়তো চায়নি কাবেরী আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থাক।
কি জানি, হয় আমার দোষ, নয় তাদের অথবা উভয়ের।
গাড়িতে যেতে যেতে আমি মোবাইল সেটে গোগল ম্যাপে গিয়ে দেখি সোনাইমুড়ি থেকে চাটখিল মাত্র ১৮ কিলোমিটার। গাড়িতে বসেই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম পাত্রী দেখা বাদ দিয়ে হলেও আমি চাটখিল যাবো। যে এলাকার এতোগুলো মানুষ এক সময় আমার এতো প্রিয় ছিলো সে এলাকার প্রকৃতি ও পরিবেশটা কেমন? তা আমি দেখবো। আমি যা মনস্থির করি, তা করি। এটা আমার চরিত্র। ভুল হলেও। আমি বিশ্বাস করি, মানুষ যে পরিবেশে বড় হয়ে উঠে তার একটা প্রভাব তার চরিত্রে থাকে। পরিবেশ দেখে ওই মানুষগুলোকে আবার নতুন করে চিনবো।
সোনাইমুড়ি বাইপাসের পাশেই মেয়ের মানে পাত্রীর বাসা। সোনাইমুড়ি বাইপাসে একটা রাস্তা চলে গেছে মাইজদি, বেগমগঞ্জ, চৌমুহনী, নোয়াখালী। আরেকটি রাস্তা গিয়েছে চাটখিল, রামগঞ্জ।
পাত্রীর বাসায় ঢুকে সবাই লিভিং রুমে বসলাম। তারা বেশ ভালো অভ্যর্থনা জানালেন। এক পর্যায়ে পাত্রী চায়ের ট্রে হাতে আমাদের সামনে এসে টি টেবিলে ট্রে রেখে তার জন্য নির্ধারিত সোফায় বসলো। মেয়েটি সুন্দরী, আকর্ষণীয়। লাল সবুজ কম্বিনেশনের থৃ পিস পরা।
অন্য অভিভাবকরা কিছু প্রশ্ন করলেন মেয়েকে। বেশিরভাগই ঘর সংসার নিয়ে।
আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হাতে টিপ দিয়ে ইঙ্গিত দিলো একজন। আমি আমতা আমতা করে মেয়েটিকে বললাম, এক্সকিউজ মি, আমি যদি আপনাকে দু’একটা প্রশ্ন করি, আপনি কি কিছু মনে করবেন?
মেয়েটি লাজুক ভঙ্গীতে মাথা নিচু করে দুই দিকে মাথা নেড়ে আমাকে অনুমতি দিলো।
আমি বললাম, রান্না বান্না নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। এখন তো মেয়েরা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়, ১০ লাখ টাকা খরচ করে মাস্টার্স করেছি কি তোমাকে ভাত রেধে খাওয়ানোর জন্য? আবার যদি তোমার পাঠ্যসূচী থেকে কোনো প্রশ্ন করি তখন যদি বলো, আমি কি এখানে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে এসেছি?
এবার মেয়েটি মাথা তুলে আমার চোখে চোখ রেখে বললো, আপনার যা খুশি প্রশ্ন করতে পারেন। আমি কিছু মনে করবো না।
আমি থ্যাংক ইউ জানিয়ে তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘পলিটিক্স’ ‘রিপাবলিক’, ‘দ্য ক্যাপিটাল’, ‘দ্য প্রিন্স’ এই চারটি বইয়ের লেখকের নাম বলতে পারো? মেয়েটি হড়বড় করে কোনো জড়তা ছাড়াই বলে ফেললো- এরিস্টটল, প্লেটো, কার্ল মার্ক্স, নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি। বাহ ! আমি খুবই খুশি হলাম। আমি তাকে দ্বিতীয় প্রশ্ন করলাম, ইউনিটারি গভর্নমেন্ট ও ফেডারেল গভর্নমেন্টের মধ্যে পার্থক্য কি? এবারো মেয়েটি কোনো জড়তা ছাড়াই বললো, বাংলাদেশ ইউনিটারি গভর্নমেন্ট। ইন্ডিয়া-আমেরিকা ফেডারেল গভর্নমেন্ট। এগুলো রাষ্ট্র বিজ্ঞানের প্রশ্ন। আমার তৃতীয় এবং শেষ প্রশ্ন, কোন জিনিস চুলায় গরম করতে দিয়ে চুলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়? মেয়েটি মুচকি হেসে লাজুক ভঙ্গীতে বললো, দুধ।
এবার আমি ফান করে বললাম, সব এলাকার কিছু নিজস্ব ভাষা আছে। বলতে না চাইলেও হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে। তোমার বর কোনো কারনে তোমাকে কখনো ধমক দিলে তুমি কি তোমাদের স্থানীয় ভাষায় বলে ফেলবে “অ্যাঁই কিচ্চি?”
এবার পাত্রীসহ ওই পক্ষের সবাই হু হু করে হেসে উঠলো। আর আমি সিগারেট খাওয়ার উসিলায় বাইরে এসে জুনিয়রকে বললাম, দেখো, আমার একজন বন্ধু আছে চাটখিল। আমি একটু দেখা করে আসি। তোমরা খেয়ে নিও। আমার ঠিক নেই।
সোনাইমুড়ি বাইপাস থেকে ৩০ টাকা ভাড়ায় একটা সিএনজি অটো রিকশা নিলাম চাটখিল বাজার। রিজার্ভ নয়। ৫ জনই বসবো। পেছনে তিন জন। সামনে দুইজন। ২০/২৫ মিনিটের ড্রাইভ। তবে এই রাস্তাটি খুবই খারাপ। চাটখিলে আমার ফরটিন জেনারেশনের কেউ কোনো দিন যায়নি। আমি কিছুই চিনি না। তবে আগে যারা ফেবুতে বন্ধু ছিলো আমার তাদের প্রোফাইলে “পরকোট দশ ঘরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়” দেখেছি। এটাই চিনি। তাও নামে।
চাটখিল বাজারে নেমে একটা ব্যাটারি চালিত রিকশা ( অটো নয়। রিকশাই) দুই ঘন্টার জন্য ভাড়া করলাম। ৩০০ টাকা। চালক জিজ্ঞেস করলো কোথায় যাবেন? বললাম, স্কুল, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা কমপ্লেক্স আর দশ ঘরিয়া গ্রাম ও তার আশে পাশের দুই তিনটা গ্রাম ঘুরে এসে আবার আমাকে এখানে নামিয়ে দেবেন।
আজ আগে কিছু ছবি দিয়েছি কোথায় কোথায় গিয়েছিলাম। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই দশ ঘরিয়া, বাইশসিন্দুর, আতাকরা, রামদেবপুর এই কয়েকটি গ্রাম ঘুরে আবার চাটখিল বাজারে এসে ভিআইপি কনফেকশনারিতে এক কাপ চা খাই। তবে চাটখিল বাজার একেবারেই মফস্বল এলাকা। এখানে ভালো মানের কোনো রেস্তোরাঁ চোখে পরেনি। হয়তো আছে। আমি দেখিনি।
কনফেকশনারিতে আমাকে যিনি সার্ভ করেছেন তার নাম কাউসার। হালকা দাড়ি আছে। ভদ্রলোক। এমন সময় যোহর নামাজের আজান হলো। আমি কাউসারের কাছে জানতে চাইলাম, এখানে কাছে কোনো মসজিদ আছে? তিনি বললেন, উনার দোকানের পাশ দিয়েই যে রাস্তাটি উত্তর দিকে গিয়েছে, একটু গেলেই খান বাড়ির মসজিদ। আমি ওই মসজিদেই যোহরের নামাজ পড়লাম। মসজিদের পাশেই খান বাড়ির পারিবারিক কবরস্থান। সুন্দর, গুছানো, ফুল গাছ আছে কবরস্থানে। একজনকে অনুরোধ করে কয়েকটা ছবি তুলি কবরস্থানের পাশে দাঁড়িয়ে। কেন যেন মনে হলো, এখানে যদি আমার কবর হতো !!! আমি খুশি হতাম। মানুষের মন কতো বিচিত্র !
উল্লেখ্য, আমি কৌশলে আগেই জেনে নিয়েছি এটা কাবেরীদের পারিবারিক মসজিদ ও কবরস্থান।মসজিদের ঠিক উল্টো দিকেই কাবেরীদের বাড়ি। কাবেরীরা বেশ অভিজাত পরিবার। খান বাড়ি।
এমন সময় জুনিয়র বন্ধু ফোন করে জানালো যে, তারা বসে আছে আমার জন্য। দুপুরের খাবার রেডি। পাত্রী পক্ষও নাকি আমার খোঁজ নিচ্ছে যে, মজার মানুষটা কই?
চাটখিল ঘুরে যে কোনো কারনেই হউক আমার খুব মন খারাপ হয়েছে। বন্ধুকে বললাম, আমার পক্ষে আসা সম্ভব নয়। তোমরা খেয়ে কুমিল্লা চলে যাও। আমার সঙ্গে কাল দেখা হবে। এরপর আমি চাটখিল থেকেই ‘হিমাচল’ বাসে টিকেট কেটে কুমিল্লা ফিরে আসি সন্ধ্যা ছয়টায়।
তবে চাটখিল নোয়াখালী শহরের শেষ সীমানায়। অনেকটা রিমোট এরিয়া। লোকজন কম। নাগরিক সুবিধার অনেক কিছুই নেই বলে মনে হলো। যদিও আমার কাছে এমন নিরিবিলি জায়গা ই ভালো লাগে। আর চাটখিল আমার কাছে বিশেষ প্রিয় বিশেষ কারনে। চিরদিন প্রিয়ই থাকবে । সবগুলো গ্রামেই জনসংখ্যা অনেক কম।
করিম চৌধুরী
২০ নভেম্বর ২০১৮
মঙ্গলবার।
Karim Chowdhury is at Chatkhil, Noakhali.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন