শীতঃ দেশে দেশে
------------------
করিম চৌধুরী
( শীতকাল। তাই শীত নিয়ে একটা লেখা। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে "মৌচাকে ঢিল" এর সহকারি সম্পাদক মি.সজীব ওনাসিস ফোন করে আমাকে বললেন,মন্টু ভাই- আগামী বিশেষ সংখ্যা 'শীত' নিয়ে। আপনি তো বহু বছর তীব্র শীতের দেশে ছিলেন। শীত নিয়ে আপনার লেখাই হবে বেস্ট। আপনার লেখাতো বড় হয় তাই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন যাওয়ার আগেই আপনাকে জানিয়ে দিলাম। শফি ভাই ( সম্পাদক শফিক রেহমান) বলেছেন, মন্টুকে বলো লেখা শুরু করে দিতে।
প্রায় তিন হাজার শব্দে শীত নিয়ে একটা আর্টিকেল লিখেছিলাম। সময়ের ব্যবধানে আমার অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে। জীবন হয়েছে এলোমেলো। গুগল ড্রাইভে টিপ দিয়ে লেখাটি পেলাম। এই লেখায় এশিয়া, ইউরোপ এবং আমেরিকা মহাদেশের শীতের কথার সঙ্গে কিছু ইনফরমেশনও আছে। বাংলাদেশেও এখন শীত। তাই শীত নিয়েই লেখা। পত্রিকার লেখা তাই অনেক খোলামেলা।)
শীতঃদেশে দেশে
----------------------
করিম চৌধুরী
লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান, ইউর অ্যাটেনশন প্লিজ। উই আর এপ্রোচিং টু নারিতা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, টোকিও। টুয়েনটি মিনিটস টু ল্যান্ডিং। প্লিজ ডু নট স্মোক। প্যাসেঞ্জার্স আর রিকোয়েষ্টেড টু ফ্যাসেন (Fasten) দেয়ার সিট বেল্ট। লোকাল টাইম ইন টোকিও ইজ টুয়েলভ টুয়েনটি এন্ড আউট সাইড টেমপারেচার ইজ মাইনাস ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। থ্যাংক ইউ।
Ladies and gentlemen, your attention please. We are approaching to Narita International Airport, Tokyo. 20 minutes to landing. Please do not smoke. Passengers are requested to fasten their seat belt. Local time in Tokyo is 12:20pm and outside temperature is minus 5 degree celsius.Thank you.
ভদ্র মহিলা ও ভদ্র মহোদয়গন, আপনাদের মনোযোগ আর্কষণ করছি। আমরা টোকিওর নারিতা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের দিকে অভিগমন করছি। বিশ মিনিটের মধ্যেই আমরা অবতরণ করবো। দয়া করে ধূমপান করবেন না। যাত্রীদের সিট বেল্ট বেঁধে নেয়ার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। এখন টোকিওর স্থানীয় সময় দুপুর ১২ টা ২০ মিনিট এবং বাইরের তাপমাত্রা মাইনাস ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ধন্যবাদ।
ইজিপ্ট এয়ারের টোকিও বাউন্ড এমএস ৬০৩ ফ্লাইটে ঘোষণা এলো।
যাত্রীরা নড়েচড়ে বসলো। সিট বেল্ট বাধার খুট খাট আওয়াজ শুরু হলো। কেবিন ক্রুদের ব্যস্ততা বেড়ে গেলো। যাত্রীদের গান শোনার জন্য দেয়া হেডফোন কালেকশান এবং যারা সিট বেল্ট বাঁধেনি তাদের সিট বেল্ট বাঁধতে সাহায্য করলো এবং মাথার উপর লাগেজ রাখার বিন ( Bin ) চেক করে যেগুলো খোলা ছিলো সেগুলো হাতের চাপে বন্ধ করে দিলো। সবার হাতে একটি করে ডিসএমবারকেশন ( Disembarkation) কার্ড ধরিয়ে দিলো। যাত্রীরা পাসপোর্ট, ভিসা দেখে ডিসএমবারকেশন কার্ড ফিল আপ করতে ব্যস্ত।
সবার ভেতরে ব্যস্ততা। ল্যান্ডিং এর সময় এমনি হয়। সে সময় প্লেনে সিগারেট খাওয়া যেতো। বোর্ডিং পাস নেয়ার সময় বলতে হতো- স্মোকিং অর নন স্মোকিং সিট! এখন সব প্লেনেই ধূমপান নিষেধ।
তরুণ বয়স। মনে তীব্র উত্তেজনা। প্লেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাঁকিয়ে দেখেছি জানুয়ারি মাসের টোকিওর পরিষ্কার নীল আকাশ। খন্ড খন্ড সাদা মেঘ। ঝকঝকে রোদ। এমন রোদ্রকরোজ্জল আবহাওয়ায় যে এমন তীব্র শীত তা প্লেন থেকে কল্পনাও করতে পারিনি। পত্র পত্রিকায় মাইনাস তাপমাত্রা সম্পর্কে পড়েছিলাম কিন্তু অনুমান করতে পারিনি মাইনাস ৫ ডিগ্রী কি অকল্পনীয় শীত !
দেশ থেকে জ্যাকেট সুয়েটার নিয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু জাপানের শীতে যে ওই সব জ্যাকেট সুয়েটার নস্যি তা কি জানতাম? গত রাত থাইল্যান্ড সময় তিনটায় আমরা ব্যাংকক থেকে উড়েছিলাম। ভোর ছয়টায় ফিলিপিন্সের রাজধানী ম্যানিলার "নিনয় অ্যাকিনো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট" এ দুই ঘন্টার ট্রানসিট ছিলো। এখন দুপুর বারোটা। টোকিওতে নামবো। থাইল্যান্ড ও ফিলিপিন্স দুটোই বেশ গরমের দেশ। ফিলিপিন্স কয়েক হাজার দ্বীপ নিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের একটি দ্বীপ দেশ। জাপানও দ্বীপ দেশ।
কয়েক বছর পর ফিলিপিন্স ঘুরতে গিয়েছিলাম। ফিলিপিন্স নিয়ে পরে লিখবো। কারণ এটা শীত নিয়ে লেখা। ফিলিপিন্স গরমের দেশ।
মাইনাস পাঁচ ডিগ্রি কেমন শীত সে বিষয়ে কোনো ধারনাই ছিলো না। প্লেন আস্তে আস্তে নিচে নামতে লাগলো। ইমিগ্রেশন ফেইস করার টেনশনও মনে ছিলো। যদিও আমরা "জাপান ফরেন ল্যাংগুয়েজ ইন্সটিটিউট ইনকর্পোরেটেড" বা সংক্ষেপে জাফলি ( JAFLI ) নামের একটি নাম করা ভাষা শিক্ষা স্কুলে ভর্তি হয়ে ঢাকার জাপান দূতাবাস থেকে ভিসা নিয়ে টোকিও গিয়েছিলাম পড়াশোনার উদ্দেশে। আমাদের ভিসা স্ট্যাটাস ছিলো ৪-১-১৬-৩ । ডিসএমবারকেশন কার্ড ফিল আপ করে পাসপোর্ট টিকেটসহ শার্টের বুক পকেটে রেখেছিলাম। ইমিগ্রেশন কাউন্টারে গিয়ে যেন খুঁজতে না হয়।
এবার ককপিট থেকে আরেকটি ছোট্ট ঘোষণা এলো।
"কেবিন ক্রু প্লিজ বি সিটেড। এয়ারক্রাফট ইজ হেডিং টু রানওয়ে"।
Cabin crew please be seated. Aircraft is heading to runway.
কেবিন ক্রুরা বসে পড়ুন। এয়ারক্রাফট রানওয়েতে যাচ্ছে। এতক্ষণ যাত্রীদের সেবা যত্নে ব্যস্ত থাকা ক্রুদেরকেও এবার সিট বেল্ট বেঁধে বসতে হবে। ল্যান্ডিং এর চূড়ান্ত মুহূর্ত। প্লেনের ভেতর শুনশান নীরবতা।
কিছুক্ষণের মধ্যেই প্লেনের চাকা রানওয়ে স্পর্শ করলো। আমরা তরুণ বয়সের প্লেনের নতুন যাত্রীরা মনে মনে আল্লাহকে ডাকলাম।
আস্তে আস্তে প্লেন বোর্ডিং বৃজের দরজায় গিয়ে থামলো। আমরা মাথার উপরে লাগেজ রাখার বিন থেকে লাগেজ নামিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। প্লেনের দরজা খোলা হলো। একজন চমৎকার সুন্দরী ইজিপশিয়ান বিমান সেবিকা দরজায় দাঁড়িয়ে জাপানি ভদ্রতায় মাথা নুইয়ে সব যাত্রীকে "থ্যাংক উই ফর ফ্লায়িং ইজিপ্ট এয়ার" Thank you for flying Egypt Air -'মিশরীয় বিমানে ভ্রমণ করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ' বলে প্রত্যেক যাত্রীকে বিদায় সম্ভাষণ জানালো।
আমরা বোর্ডিং বৃজ দিয়ে হেঁটে হেঁটে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে এসে কোনো ঝামেলা ছাড়াই পাসপোর্টে Admitted সীল নিয়ে জাপানে ঢুকলাম।
ওয়াও!
তখনো শীতের তীব্রতা মোটেও অনুভব করিনি। উন্নত দেশের পুরো এয়ারপোর্ট শীতকালে সেন্ট্রালি হিটিং এবং গরমকালে সেন্ট্রালি এয়ারকন্ডিশনড থাকে।
আমরা কুমিল্লা সিটির কয়েকজন একই প্লেনে গিয়েছিলাম। রতন নামে আমাদের এক অল্প পরিচিত বন্ধু (বিমানে পরিচয় ) বোর্ডিং বৃজ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,করিম ভাই, জাপানে নাকি খুব শীত? আমি ফাইজলামি করে বললাম, আরে ধুর! জাপান সূর্যোদয়ের দেশ। সকালে সূর্য উঠলে এই দেশের মানুষ সবার আগে তা দেখতে পায়। এখানে এতো শীত নেই।
ও বোকার মতো বললো, ঠিক বলেছেন,দেশটা সূর্যের কাছাকাছি হবে। শীত বেশি হবে না।
নারিতা টোকিও থেকে ৮০ কিলোমিটার। বেশিরভাগ উন্নত দেশে এয়ারপোর্ট মূল শহর থেকে বেশ দূরে। স্কাই লাইনার ( Sky Liner ) এক্সপ্রেস ট্রেনে টোকিওর সঙ্গে যোগাযোগ। এই ট্রেনে টোকিও পৌঁছাতে মাত্র এক ঘন্টা সময় লাগে।
বাসেও যাওয়া যায়।
ঘুরানো কাঁচের দরজা ঠেলে এয়ারপোর্টের বাইরে আসতেই ছ্যাঁত করে গায়ে বাতাস লাগার সঙ্গে সঙ্গে গাল,কান আর হাতের আঙুল যেন অবস হয়ে গেলো। কারোই সর্দি নেই কিন্তু সবার নাক দিয়ে পানি পরছে। এতো শীতে আমরা সবাই কেমন যেন উম্মাদের মতো হয়ে গেলাম। কেউ স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারছিলাম না। দাঁতে দাঁতে খট খট করতে লাগলো। ট্রেন ষ্টেশনে বসে আমরা শীতে জমে যাচ্ছিলাম। দশ মিনিট পরই ট্রেন। অকল্পনীয় শীতে দশ মিনিটকে অনন্তকাল মনে হচ্ছিলো।
ট্রেন ষ্টেশনে অনেকগুলো ভেন্ডিং মেশিন ছিলো। তাও জীবনে প্রথম দেখা। গরম ঠান্ডা সব ডৃংকস ছিলো ওই সব মেশিনে। ডৃংকসের নিচে নাম ও দাম লেখা ছিলো। জাপানি মুদ্রার নাম ইয়েন। আমরা এয়ারপোর্টেই ডলার চেইঞ্জ করেছিলাম। একশ ডলারে পেয়েছিলাম বারো হাজার ইয়েন। এক কাপ কফির দাম দেখলাম তিনশ ইয়েন।
আমরা মেশিনে টাকা ঢুকিয়ে বাটন টিপে গরম কফি নিলাম। ও মা! বাটন টিপলে দ্রুম করে কফির ক্যান পরে কিন্তু হাতে নিয়ে কেউ আর খোলে না। গরম কফির ক্যানটা মোট করে ধরলে কিছুটা হলেও আরাম লাগে। জীবনে সেই প্রথম-দি ভেরি ফার্স্ট টাইম ইন লাইফ গরমের দেশ থেকে মাইনাস পাঁচ ডিগ্রির দেশে। পরে ইউরোপ আমেরিকা গিয়ে দেখেছি পশ্চিমা দেশের শীত আরো বেশি নিষ্ঠুর।
স্কাই লাইনার ট্রেন প্লাটফর্মে ঢুকলো। ইলেকটৃফাইড ট্রেন। জাপানি ভাষায় ছোট ঘোষণা শুনলাম। মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝিনি। হুস করে স্লাইডিং দরজা খোলে গেলো।
আমরা ট্রেনে উঠে বসলাম। আবার গরম। কি যে শান্তি! ট্রেনের ভেতরে বসে কিছুতেই বুঝা যাবে না যে বাইরে কি গজব? উন্নত দেশে শীতকালে ট্রেন,বাস,কার সবই হিটিং সিসটেমে গরম থাকে।
স্কাই লাইনার ট্রেনের সিটিং অ্যারেঞ্জমেন্ট দেখে আমাদের বিস্ময়ের সীমা রইলো না। সিটগুলো বেশ বড়। আমাদের সোহাগ বা গ্রীন লাইন বাসের বিজনেস ক্লাস সিটের মতো। সামনে পেছনে দুটো সিটের গ্যাপ অনেক বেশি। প্রতি সিটের পেছনে নিচের দিকে গাড়ির একসেলারেটর (accelerator)এর মতো ছোট একটি প্যাডেল ছিলো। ওই প্যাডেলে পা দিয়ে হালকা চাপ দিলে সামনের সিট দুটো আস্তে উল্টে ঘুরে যায়। চারজনের গ্রুপ হলে যেন সবাই মুখোমুখি বসতে পারে সেই ব্যবস্থা। দ্রুতগতিতে ট্রেন চলছে টোকিও অভিমুখে। আমরা আরাম করে কফি খাচ্ছি আর বাইরের জাপান দেখছি।
দু'দিকে অনেক কাঠের তৈরি বাড়ি দেখলাম। এক ঘন্টা পর আমরা টোকিওর ওএনও(UNO) স্টেশনে পৌঁছলাম। আবার শীত।
এবার টোকিও সিটি সার্ভিস বাসে আমরা পৌঁছলাম আমাদের থাকার ঠিকানা ডাউন টাউন টোকিওর আকাবেনি আবাসিক এলাকায়।
সেদিন তুষারপাত হয়নি। ইউরোপ আমেরিকার তুলনায় জাপানে তুষারপাত কম হয়। শীতের স্থায়িত্বও কম। মার্স মাসের শেষ থেকে শীত নেই বললেই চলে।
আমরা তিন বাল্যবন্ধু ও ক্লাসমেট একসঙ্গে থাকবো। আমি, মুন্না, কাওসার। মুন্না এখন জেনিস শু ( Jennys Shoe) এর মালিক। শিল্পপতি। আমরা তিনজন এক রুম শেয়ার করবো। বন্ধুদের মধ্যে রেজাল্টের দিক দিয়ে আমিই ছিলাম সবচেয়ে মেরিটোরিয়াস। এসএসসি, এইচএসসি দুটোই ফার্স্ট ডিভিশন। আমরা তিনজন এক রুম শেয়ার করবো। এই এক রুমেই থাকা, রান্না করা, খাওয়া, কাপড় রাখা, কিছু বই পুস্তক, জুতা-মোজা সবই ওই বারো বাই চৌদ্দ রুমে। টয়লেট রুমের বাইরে। ওটা ছিলো পুরনো আমলের কাঠের দোতলা বাড়ি। আমরা দোতলায় ছিলাম। সবার মনে একটাই প্রশ্ন ছিলো, এতো বেশি শীতে কিভাবে সারভাইভ করবো?
আমরা কিছু ফাষ্ট ফুড; কলা, বিস্কুট, দুধ, জুস কিনে ষ্টক করে রেখেছিলাম। খুব প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যেতাম না। আমাদের বাসায় হিটিং সিসটেম ছিলো না। পুরনো বাড়ি। ভাড়া কম। সারাদিন রাত লেপ গায়ে দিয়ে বসে থাকতাম। সবচেয়ে সমস্যা ছিলো আমাদের ওই বাসায় রুমের বাইরে ছোট একটা টয়লেট ছিলো। গোসল করার কোন ব্যবস্থা ছিলো না। পাঁচ দিন আগে ব্যাংককের এক হোটেলে গোসল করেছিলাম।
ইতিমধ্যে নাকে ধরে একটু একটু বিয়ার খাওয়া শিখেছিলাম। জাপানের বাইরে সাপ্পোরো ( Supporo) খুব জনপ্রিয় বিয়ার হলেও জাপানিদের কাছে বেশি প্রিয় কিরিন (Kirin) বিয়ার। আমাদের সিনিয়র খুব ফানি ক্যারক্টোর ঝাউতলার বাকের ভাই বলেছিলেন, বিয়ার খেলে তো শীত আরো বেশি লাগবে। তোরা বরং হুইস্কি খাওয়ার অভ্যাস কর। শরীর গরম থাকবে। শীত কম লাগবে।
জাপানের নিক্কা (Nikka) হুইস্কি খুবই হার্ড ডৃংক। পয়তাল্লিশ পার্সেন্ট অ্যালকোহল। ইতিমধ্যে তাপমাত্রা কমে মাইনাস আট ডিগ্রীতে এলো।
এক রাতে দুই বোতল নিক্কা হুইস্কি এনে আমরা আটজন শেয়ার করছিলাম। গোল হয়ে ফ্লোরে বসে শুরু হলো হুইস্কি খাওয়া। এক বোতল শেষে পাঁচজন কাত। কেউ বমি করছিলো। কেউ ঘেমে অস্থির। কাওসার বাথরুমে গিয়ে পরে ছিলো। রতন সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে নাচতে শুরু করছিলো। সবাই জীবনে প্রথম হুইস্কি খেয়েছি। ন্যাংটা তো হবেই।
সেদিন তুষারপাত হয়েছিলো। বাকের ভাই বললেন- আমার তো খুব গরম লাগছেরে। আমি, মুন্না, নিখিল স্বাভাবিক ছিলাম। আমরা চালাকি করে কম খেয়েছি। এই তিনজনে বাকের ভাইকে পাঁজাকোলা করে বাইরে এনে তুষারের মধ্যে শুইয়ে দিয়েছিলাম। বাকের ভাইকে বলেছিলাম, হুইস্কি খেয়ে শরীর গরম করার বুদ্ধি আপনি দিয়েছিলেন- এবার তুষারের মধ্যে ঠান্ডা হোন। বাকি পাঁচজনের তো যায় যায় অবস্থা।
তখনো গোসল করিনি। সিনিয়র কয়েক ভাই যারা আগে থেকেই জাপানে ছিলেন তাদের কাছে জেনেছিলাম, জাপানে প্রত্যেক এলাকায় পাবলিক বাথরুম আছে। সেখানে অনেক মানুষ গোসল করে এমনকি জাপানিরাও পাবলিক বাথরুম ব্যবহার করে। এই পাবলিক বাথকে জাপানি ভাষায় বলে সেনতু (Sento)।
জানলাম, সেনতুতে গোসল করতে হবে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে লাজুক ছিল কাওসার। উলঙ্গ হয়ে গোসল করার কথা শোনে কাওসার বললো, আমি শালার জাপানেই থাকবো না। এখানে কি ন্যাংটা হতে এসেছি?
জাপানের আবহাওয়া সম্পর্কে জানার জন্য কয়েকটি ইংরেজি পত্রিকা কিনেছিলাম। দি জাপান টাইমস, মাইনিচি ডেইলি নিউজ, আশাহি শিমবুন, ইউমিউরি শিমবুন।
জাপানে যারা থাকেন তাদের প্রায় সবারই ন্যাংটা হয়ে গোসল করার অভিজ্ঞতা আছে। অনেকেই লজ্জায় বলেন না। আমার লজ্জা শরম একটু কম। বিদেশের বিচিত্র অভিজ্ঞতা খোলামেলা শেয়ার করতে পছন্দ করি। এতে কেউ আমাকে পছন্দ করুক আর নাই করুক।
পাঁচ দিন হয় জাপানে এসেছি। এখনো গোসল করিনি। গায়ের গন্ধ, রুমের গন্ধ, মোজার গন্ধে রুমে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠেছিলো। ইতিমধ্যে জাপানে তুষারপাত শুরু হয়ে গিয়েছিলো। পাঁচদিন পর কাওসার, আমি, মুন্না, বাকের ভাই, মাহাবুব, রতন, নিখিল, আলিম তুষারপাতের মধ্যেই রাত নয়টায় মিছিল করে সেনতুতে গিয়েছিলাম গোসল করতে। সেনতু ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে।
আগেই জেনেছিলাম, সেনতুতে গেলে সাবান, শ্যাম্পু, টাওয়েল কিছুই নিতে হয় না। সবই সেনতু কর্তৃপক্ষ দিয়ে থাকে। প্যান্ট, শার্ট, জ্যাকেট পড়ে আমরা সেনতুতে গেলাম। বাসা থেকে ওয়াকিং ডিসট্যান্স। একটু পরেই আমরা একযোগে ন্যাংটা হবো।
এবার সেনতুর বর্ণনা। আমি খোলামেলা লিখবো। যারা এই আর্টিক্যাল পড়বেন তারা সহজভাবে নেবেন প্লিজ। It's an Experience.
প্রায় তিন হাজার স্কয়ার ফিট জায়গা নিয়ে এই সেনতু। দুটো সেকশন। এক সেকশনে পুরুষ অন্য সেকশনে নারীদের গোসল করার ব্যবস্থা।
আমরা পুরুষ সেকশনে ঢুকে দেখি কাউন্টারে একজন মধ্য বয়সি ভদ্র মহিলা। পুরুষ সেকশনে মহিলা দেখে আমরা খুবই বিব্রতবোধ করছিলাম। এই মহিলার সামনে ন্যাংটা হবো? সেনতুর কাউন্টারটি হোটেলের লবির মতো। পঞ্চাশজন বসার ব্যবস্থা। দেয়ালে লাগোয়া পঞ্চাশটি বড় বক্স। লেটার বক্সের মতো। প্রতি বক্সে নাম্বার দেয়া ছিলো। ফ্রসটেড গ্লাস দিয়ে পার্টিশান দেয়া। ভেতরে গোসলের ব্যবস্থা। চার্টে গোসল করার দাম লেখা ছিলো।
জাপানি মুদ্রার নাম ইয়েন। একশ বিশ ইয়েন কাউন্টারে জমা দিলে ভদ্র মহিলা একটি বড় টাওয়েল, ওয়ান টাইম ইউজ একটি শ্যাম্পু এবং একটি ছোট সাবান দিলেন। সঙ্গে বক্সের চাবি। সবাই এক যোগে ন্যাংটা হয়ে আমাদের পরনের জামা কাপড় ওই বক্সে রেখেছিলাম। একশ বিশ ইয়েন সে সময়ের হিসাবে এক আমেরিকান ডলার।
আমরা নাম্বার অনুযায়ি বক্স খোলে একে একে শার্ট, প্যান্ট, গেঞ্জি, জ্যাকেট, সোয়েটার, আন্ডার গার্মেন্টস, জুতা, মোজা খোলে বক্সে রাখলাম। টাওয়েল পড়া যাবে না। এটা নিয়ম। এখানে ন্যাংটাই থাকতে হবে। কি এক অদ্ভুত নিয়ম! ওখানে কিছু জাপানিও ছিলো। আমরা তখন সবাই ন্যাংটা। শুরু হলো হাসাহাসি।
কার বিশেষ অঙ্গ কত লম্বা ও মোটা, কারটা সাইজে ছোট, কারটা খুব কালো, কার পিউবিক হেয়ার বা যৌন কেশ কতো বড়, কে কতদিন লোয়ার পার্ট সেভ করেনি এসব আলোচনা করতে করতে আর হাসতে হাসতে আমরা স্লাইডিং দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম।
পঞ্চাশ জন একসঙ্গে গোসল করার সুন্দর ব্যবস্থা। আমাদের দেশে মসজিদে মুসুল্লিদের অযু করার জন্য যেমন বসার ব্যবস্থা এবং সামনে টেপ ঠিক তেমন অ্যারেঞ্জমেন্ট। সামনে লম্বা গ্লাস। ফ্লোর দামি টাইলস করা। টেপের দুটো নব। লাল ও সবুজ। লালটায় গরম আর সবুজটায় ঠান্ডা পানি। নিচে চিকন ড্রেন। একটা প্লাস্টিকের বসার টুল। আছে একটা মাগ। এক কোণায় একটি বড় বাথটাব। এটাকে মিনি সুইমিং পুল বলা যায়। বিশ ফিট বাই চৌদ্দ ফিট। কোমড় পর্যন্ত গভীর। টাবের কোণায় বড় একটি মিটার ছিল। যাতে টাবের পানির টেমপারেচার উল্লেখ থাকে। আমি দেখেছিলাম, এই টাবের পানির টেমপারেচার ছে চল্লিশ ডিগ্রি ছিলো। আমার বন্ধু কাওসার টাবে এক পা দিয়ে বলেছিল- মা গো মা। কী গরম পানি। কাওসার আর কোন দিন টাবে নামেনি। আমার এই বন্ধুটি এখন তাবলীগ জামায়াতের আমীর। ধর্ম কর্ম নিয়েই পরে থাকে। পাঁচ সন্তানের জনক। আমরা একই শহরে থাকি বলে মাঝে মাঝে কাওসারের সঙ্গে দেখা হলে আমি তর্জনী দিয়ে ওর পেটে খোঁচা মেরে বলি, ন্যাংটা হয়ে গোসল করবি নাকি আরেকবার? তুই তো এখন আমীর।
কাওসার আমার হাত চেপে কানের কাছে ফিস ফিস করে বলে আল্লাহর দোহাই, তুই মান-ইজ্জত মারিস না। আমি তাকে বলি, তুই মদমুদ খেয়ে শতশত মানুষের সামনে ন্যাংটা হয়ে গোসল করে এখন যে হুজুর সাজলি কাজটা কি তুই ঠিক করলি? কাওসার পারেনা আমার পায়ে ধরে। কিছুটা অভিমান করে বলে, তোর সঙ্গে জাপানে যাওয়াই ভুল হয়েছে।
সেনতুতে পার্টিশান দিয়ে আড়াল করা অন্য সাইডে মহিলাদের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। পার্টিশানের উপরের দিকে দুই ফিট চওড়া একটি গ্যাপ ছিলো। আমি কৌতূহলী হয়ে দুইবার লাফ দিয়ে মহিলাদের উলঙ্গ হয়ে গোসল করার লাইভ দৃশ্য দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এই গ্যাপটা এতই উপরে যে অমিতাভ বচ্চন লাফ দিয়েও দেখতে পারবেন না।
আমার লাফ দেয়া দেখে বাকের ভাই তার স্বভাবসুলভ রসবোধ নিয়ে ধমক দিয়ে বললেন, মন্টু, ফাইজলামি করবি না। ন্যাংটা মেয়ে তুই জীবনেও দেখিস নি? এটা কুমিল্লা সিটি না। যা খুশি তা করবি। ওমাওয়ারিসান এসে ন্যাংটা অবস্থায় ধরে নিয়ে যাবে।
পুলিশকে জাপানি ভাষায় ওমাওয়ারিসান বলে।
গোসল শেষে আবার বক্স খোলে প্যান্ট, শার্ট, জ্যাকেট পড়ে কাউন্টারে চাবি ও টাওয়েল জমা দিলাম। আমাদের কেউ দেখলে বিশ্বাসই করবে না যে এই ছেলেগুলো একটু আগেও ন্যাংটা ছিলো। কি ভদ্র পোশাক! বাসায় ফিরছিলাম। আর ওই প্রাপ্ত বয়সে ন্যাংটা হওয়ার তাজা অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলছিলাম সবাই। বাকের ভাই আমাদের পাঁচ ছয় বছরের সিনিয়ার হলেও খুবই ফ্রেন্ডলি আর রসবোধ সম্পন্ন মানুষ। তিনি বললেন, টোকিও এসে একটা লাভ হয়েছে। বিনা পয়সায় বিভিন্ন রকমের বিশেষ অঙ্গ দেখলাম। আর কাউন্টারে বসা জাপানি মহিলাটার চোখ সার্থক হয়েছে। এই মহিলা বহু জাতি, ধর্ম আর বর্ণের পুরুষের বিশেষ অঙ্গ দেখার সৌভাগ্য অর্জন করছেন।
কয়েকদিন পর আপ টাউন টোকিওর শিনজুকু এলাকায় একটা পার্ট টাইম জব নিয়েছিলাম। তখন প্রায় প্রতিদিনই তুষারপাত হতো। জীবনে প্রথম তুষারপাত দেখেছিলাম জাপানে। বৃষ্টির শব্দ থাকে কিন্ত তুষারপাত নিঃশব্দ।
একদিন সন্ধ্যায় কাজ শেষে বাসায় ফিরছিলাম। তুষারপাতে হাঁটার একটা আলাদা কৌশল ও ষ্টাইল আছে। সেই হাঁটা তখনো রপ্ত করতে পারিনি। রাস্তাঘাট সব সাদা। ট্রেন ষ্টেশনের কাছাকাছি আসতেই তুষারে স্লিপ করে ধপাস করে চিৎ হয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশে বর্ষাকালে গ্রামের কাদা রাস্তায় যেমন অনেকে পিছলে পড়ে যায়, যাকে স্থানীয় ভাষায় বলে 'আছাড়' খাওয়া। আমিও টোকিওতে প্রচন্ড শীতে তুষারে স্লিপ করে আছাড় খেয়েছিলাম। কিছুটা লজ্জা পেয়েছিলাম। কেউ যাতে দেখতে না পায় তাই তাড়াতাড়ি উঠে এক পা এগুতেই আবারো ধপাস।
এবার আর উঠিনি। তুষারের মধ্যে গাড়াগড়ি করতে লাগলাম। কেউ দেখলে যেনো বুঝতে না পারে যে আমি আছাড় খেয়ে পড়েছিলাম। যেনো মনে করে, আমি তুষার নিয়ে খেলা করছি। বিদেশে অনেকেই তুষারে খেলা করে। জাপানের আরো অনেক বিষয় পরে শেয়ার করবো।
এবার চলুন ইউরোপের শীত কেমন একটু জানি। আমি আর নিউটন ইটালির রাজধানী রোম-এর লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট-এ বসেছিলাম। দীর্ঘ সময়ের ট্রানজিট ছিলো। আমরা দুজন ইনডিয়ার বম্বে (এখন মুম্বাই) থেকে উড়ে এসেছি। ইটালির এয়ারলাইন্স আল ইটালিয়া ফ্লাইটে। আমাদের গন্তব্য ছিলো সাবেক যুগোশ্নোভিয়ার রাজধানী বেলগ্রেড। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম নেতা মার্শাল জোসেফ ব্রুজ টিটোর দেশ। তখনো যুগোস্লাভিয়া ভেঙে টুকরো হয়নি। আমি অস্টৃয়া থাকতেই চোখের সামনে যুগোস্লাভিয়া ভেঙে খান খান হয়ে গেলো।
একে একে চারটি যুদ্ধের মাধ্যমে ক্রোয়েশিয়া, মেসিডোনিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা আর স্লোভেনিয়া স্বাধীন হয়ে যায়। সার্বিয়া আর মন্টেনিগ্রো ‘ফেডারেল রিপাবলিক অব যুগোস্লাভিয়া’ নাম নিয়ে কিছুকাল টিকে থাকলেও ২০০৬ সালে মন্টেনিগ্রো স্বাধীন হয়ে গেলে পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে যায় যুগোস্লাভিয়া নামের দেশটি। পরবর্তীতে সার্বিয়া ভেঙে দুটি রাষ্ট্র হয়। একটি সার্বিয়া অপরটি কসোভো।
স্বাধীন হয়ে যাওয়া দেশসমূহঃ
১. ক্রোয়েশিয়া- রাজধানী - জাগরেব, জনসংখ্যা - ৪৫ লাখ।
২. মেসিডোনিয়া-রাজধানী - স্কপজি, জনসংখ্যা - ২০ লাখ।
৩. বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা - রাজধানী - সারাজেভো, জনসংখ্যা - ৩০ লাখ ২ হাজার।
৪. স্লোভেনিয়া- রাজধানী - লুবলিয়ানা - জনসংখ্যা - ২২ লাখ।
৫. মন্টেনিগ্রো- রাজধানী - পোডগোরিকা - জনসংখ্যা- ৬ লাখ ২২ হাজার।
৬. সার্বিয়া- রাজধানী-বেলগ্রেড- জনসংখ্যা - ৬৪ লাখ ৩ হাজার।
৭. কসোভো- রাজধানী -প্রিস্টিনা - জনসংখ্যা -১৮ লাখ ৩ হাজার।
যুগোস্লাভিয়ার আয়তন ছিলো ২,৫৫,৯৫০ বর্গ কিলোমিটার। এই দেশটি ভেঙে যখন ৭টি দেশ হয় তখন সব ক'টি দেশই ছোট হয়ে যায়।
রোমের দি ভিঞ্চি এয়ারপোর্টটি বড়, ব্যস্ত এবং আকর্ষণীয়। ইটালি একটি ঐতিহ্যবাহী দেশ। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির নামে এই এয়ারর্পোট। দীর্ঘ সময়ের ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার্সদের জন্য এই এয়ারপোর্টের বাথরুমে গোসল করারও ব্যবস্থা ছিলো। হয়তো এখনো আছে। বম্বের শান্তা ক্রুজ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে স্থানীয় সময় রাত একটায় আল ইটালিয়া ফ্লাইট টেক অফ করেছিলো। রোম পৌঁছেছিলাম ইটালি সময় ভোর পাঁচটায়। মনে রাখতে হবে, বম্বের সঙ্গে ইটালির সময়ের ব্যবধান সাত ঘন্টা। অর্থাৎ বম্বে বা মুম্বাইতে যখন রাত একটা তখন ইটালি সময় সন্ধ্যা ছয়টা। ইউরোপ পশ্চিমে বলে সাত ঘন্টা পিছিয়ে থাকে।
এগারো ঘন্টার ননষ্টপ ফ্লাইট ছিলো বম্বে- রোম। বোয়িং ৭৪৭ জাম্বো জেট প্লেনে। সাড়ে পাঁচশো যাত্রী বহন করে ৭৪৭-৪০০ বোয়িং। ওইদিন বিকেল পাঁচটায় যুগোস্লাভ এয়ারলাইন্স জাট (JAT) এ আমরা বেলগ্রেড যাবো। রোম থেকে বেলগ্রেড মাত্র এক ঘন্টার জার্নি। ইটালি এবং সাবেক যুগোস্লাভিয়া প্রতিবেশি দেশ। সারাদিন ভিঞ্চি এয়ারপোর্টে শুয়ে, বসে, টিভি দেখে, শপিং সেন্টারে ঘুরে সময় কাটিয়ে ছিলাম। কাঁচ ঢাকা ট্রানজিট লাউঞ্জে বসে দেখেছি কি তীব্র তুষারপাত হচ্ছে ইটালিতে।
ইটালির মুদ্রার নাম লিরা। পঞ্চাশ আমেরিকান ডলার চেইঞ্জ করে পেয়েছিলাম আটান্ন হাজার লিরা। নিউটন টাঙ্গাইলের ছেলে। ইউনিভার্সিটিতে আমার এক বছরের জুনিয়র ছিলো। ঢাকা ভার্সিটির জসিম উদ্দিন হলে দুইশ একুশ নাম্বার রুমে আমরা থাকতাম। ওটা ছিলো আমান ভাইয়ের রুম। বিএনপি’র ডাক সাইটে ছাত্র নেতা আমান উল্লাহ আমান ভাই তখন জসিম উদ্দিন হলের সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। পরে তিনি ঢাবি’র ভিপি হয়েছিলেন। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে আমান ভাই অসামান্য ভূমিকা রেখেছিলেন। আমি তখন মাষ্টার্স ফাইনাল ইয়ারের ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স ডিপার্টমেন্টের ছাত্র ছিলাম।
এতো লিরা দেখে নিউটন আবাক হয়ে বলেছিলো, অনেক টাকা। আমি বলেছিলাম–দোস্ত, বেশি খুশি হয়ো না। জাপানে প্রথম দিন একশ ডলার চেইঞ্জ করে পেয়েছিলাম বারো হাজার ইয়েন। আর এক প্যাকেট মাইল্ড সেভেন (Mild Seven) সিগারেটের দাম ছিল দুইশ পঞ্চাশ ইয়েন।
লিরাগুলো নিয়ে আমরা এয়ারপোর্টের ভেতরে এক রেষ্টুরেন্টে ইটালির বিখ্যাত খাবার পিৎজা আর দুটো হাইনিক্যান বিয়ার খেয়েছিলাম। বিল হয়েছিলো বিয়াল্লিশ হাজার লিরা।
বিকেল চারটায় আমরা ভিঞ্চি এয়ারপোর্ট থেকে টেক অফ করেছিলাম। বেলগ্রেড ইমিগ্রেশনে কোনো ঝামেলা হয়নি। তখন যুগোস্লাভিয়ায় বাংলাদেশিদের জন্য পোর্ট অফ এন্টৃ বা ভিসা অন অ্যারাইভ্যাল ছিলো। বেলগ্রেড এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে দেখেছিলাম সারা শহর তুষারে ঢাকা। ডিসেম্বরের তীব্র শীত। বেলগ্রেডে ল্যান্ডিং এর আগেই বিমান থেকে দেখেছিলাম প্রচন্ড তুষারপাত হচ্ছিলো।
বেলগ্রেডের একটা দামি হোটেলে আমরা উঠেছিলাম।
যুগোস্লাভিয়ার মুদ্রার নাম ছিল দিনার। এয়ারপোর্টে একশ ডলার চেইঞ্জ করে পেয়েছিলাম দেড় মিলিয়ন যুগোশ্লাভ দিনার। অর্থাৎ পনের লাখ দিনার। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে যেতে ট্যাক্সি ভাড়া ছিলো চার লাখ দিনার। হোটেলের ডাবল রুমের ভাড়া ছিলো আট লাখ দিনার। দশ হাজারের নীচে কোনো নোট নেই।সেদিন বেলগ্রেডের তাপমাত্রা ছিলো মাইনাস আট ডিগ্রি। যুগোস্লাভিয়া তুলনামূলকভাবে কিছুটা গরিব দেশ।
যুগোশ্লাভ মেয়েরা খুব ফ্রেন্ডলি। প্রচন্ড শীতেও ওরা স্কার্ট পড়ে। আকর্ষণীয় ফিগারের অধিকারি। বিদেশিদের সঙ্গে সহজেই মেশে। প্রচুর ডৃংক করে। এবং খুবই সেক্সি। এগারো দিন যুগোশ্লাভিয়া ছিলাম। প্রতিদিন তুষারপাত হতো। বেলগ্রেডের ঐতিহাসিক অনেক কিছু দেখে আমি আর নিউটন গিয়েছিলাম অ্যাডরিয়াটিক সী (Adriatic Sea) বা অ্যাডরিয়াটিক সাগর দেখতে। অবিশ্বাস্য তুষারপাত হচ্ছিলো। তাপমাত্রা ছিলো মাইনাস এগারো ডিগ্রি। আহারে শীত! হাতের জ্বলন্ত সিগারেট নিভে গিয়েছিলো ঠান্ডায়। কানে হাত দিয়ে ধরে দেখলাম, আমার কান নেই। অতিরিক্ত ঠান্ডায় কান অবস হয়ে গিয়েছিলো।
পাঁচ দিন বেলগ্রেডে শীত খেয়ে আমরা গিয়েছিলাম সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর জাগরেব (Zagreb)। জাগরেব এখন ক্রোয়েশিয়ার রাজধানী। বেলগ্রেড থেকে জাগরেব ৪৫০ কিলোমিটার। আমরা বেলগ্রেড থেকে ট্যাক্সিতে জাগরেব গিয়েছিলাম। যেদিকে তাঁকাই শুধু তুষার আর তুষার। জাগরেব পৌঁছে অনুভব করলাম, বেলগ্রেডের চেয়ে জাগরেবের শীতের তীব্রতা অনেক বেশি। তাপমাত্রা ছিলো মাইনাস নয় ডিগ্রি।
জাগরেব তিন দিন ঘুরে আমরা চলে গেলাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর যুগোশ্লাভিয়ার সুন্দর শহর মেরিবোর (Mariboor)। মেরিবোর ছবির মতো শহর। ওখানে আরো বেশি শীত। তাপমাত্রা ছিল মাইনাস এগারো ডিগ্রি। নিউটন বলেছিলো, এই শীতে মানুষ বেঁচে থাকে কিভাবে? আমাদের ধর্মগ্রন্থে দোজখের আগুনের বণর্না আছে। সৃষ্টিকর্তা দোজখে আগুন না দিয়ে এমন শীত দিলেই তো কাজ হতো বেশি। মেরিবোর শহরটি প্রতিবেশি দেশ অষ্টৃয়ার গ্রাজ (Graz) শহরের খুব কাছে।
আমাদের সময় বাংলা পরীক্ষায় একটা সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন থাকতো। টিকা লিখ। আমাকে যদি শীত নিয়ে টিকা লিখতে বলা হয় তবে আমি বই লিখে ফেলতে পারবো। যুগোশ্লাভিয়া পনেরো দিন থেকে যুগোশ্লাভিয়ান শীত খেয়ে আমরা চলে গেলাম প্রতিবেশি দেশ অষ্টৃয়ার রাজধানী ভিয়েনা।
ছয় বছর অষ্টৃয়া ছিলাম। অষ্টৃয়াকে বলা হয় বাফার জোন। বাংলাদেশের প্রায় সমান মধ্য ইউরোপের অষ্টৃয়া দেশটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব লীলাভূমি। সাতটি ষ্টেট নিয়ে অষ্টৃয়া ফেডারেল সরকার পরিচালিত একটি দেশ। বর্তমান জনসংখ্যা বিরাশি লাখ। অষ্টৃয়ার ভাষা জার্মান। মুদ্রার নাম সিলিং। শিল্প সংস্কৃতিতে অষ্টৃয়া বিখ্যাত দেশ।
বিশ্ব বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ মোজার্ট (Mozart) অষ্টৃয়ার নাগরিক। জার্মান ডিক্টেটর অ্যাডলফ হিটলার (Adolf Hitler)এর জন্ম অষ্টৃয়ার ব্রনো (Brno) শহরে। সতেরশো শতাব্দিতে ভিয়েনার শনব্রুন এলাকায় নেপোলিয়ান এর হেডকোয়ার্টার ছিলো। ভিয়েনার অন্যতম আকর্ষণীয় ও দর্শণীয় জায়গা এই শনব্রুন।
অষ্টৃয়ার শীত আরো বেশি। ভিয়েনা ড্যানিয়ুব (Danube) নদীর তীরে অবস্থিত খুব পরিচ্ছন্ন শহর। সামারে কত হাজার বার ড্যানিয়ুর নদীতে গোসল করেছিলাম, বোটিং করেছিলাম তা বললে অনেক কথা। অন্য একদিন বলবো। ড্যানিয়ুব নদীকে জার্মান ভাষায় দোনাও (Donau) বলে।
আমরা কয়েকজন চার বেড, লিভিং, ডাইনিং, কিচেন, দুই বাথরুম, দুই দিকে ব্যালকনিসহ একটি আধুনিক ফ্ল্যাটে ভিয়েনার এক অভিজাত এলাকায় থাকতাম।
ডিসেম্বর মাস। বিকেল থেকেই পেঁজা তুলার মতো পাতলা তুষার দুলতে দুলতে নামছিলো। তাপমাত্রা ছিলো মাইনাস বারো। সেদিন ছিল উইকএন্ড। আমি, নিউটন, সেলিম, চঞ্চল, মাইকেল, পিটার, টমাস রুমে বসে শরীর গরম করার জন্য শিভাস রিগ্যাল হুইস্কি খাচ্ছিলাম। নিউটন ব্যালকনির দরজা খুলে দেখলো প্রায় ষোল ইঞ্চি তুষারপাত হয়েছিলো। রুমে কিন্তু হিটিং সিসটেমে স্বাভাবিক তাপমাত্রা ছিলো। আমরা শর্টস আর গেঞ্জি পড়ে রুমে মিউজিক অন করে ডৃংক খাচ্ছিলাম।
শিভাস রিগ্যালে ভালোই অ্যাকশন করেছিলো। উল্টাপাল্টা অনেক কথার পর সিদ্ধান্ত হলো সবাই একটা করে গান গাইতে হবে। আমি গেয়েছিলাম এসপিবালা সুব্রানিয়ামের
“বহুত পেয়ার কারতে হ্যায় তুমকো সনম-কসম চাহে লে লাও খোদা কি কসম”।
সাজন মুভির খুব সুন্দর গান। নিউটন এবার বললো , সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে ব্যালকনিতে তুষারের উপর এক মিনিট যে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে পুরো শীতকালে নিউটন তাকে ডৃংক খাওয়াবে। অন্যরা সবাই ব্যালকনিতে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এসে বলেছিলো, ভিক্ষার দরকার নাই, কুত্তা সামলাও। এই শীতে ন্যাংটা হয়ে দাঁড়ালে কফিন চিকিৎসা দিতে হবে।
অনেকেই বলেন, আমি নাকি দুরন্ত স্বভাবের মানুষ। আমি নিউটনের প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলাম। তবে শর্ত ছিল, একই ডৃংক বার বার খাওয়া হবে না। টিচার্স, জনি ওয়াকার ব্ল্যাক ও রেড লেবেল, ব্লু লেবেল, হোয়াইট হর্স, পাসপোর্ট, হেনেসি অর্থাৎ একেক সপ্তাহে একেক ডৃংক।
আমি শর্টস ও গেঞ্জি খুলে একটা টাওয়েল পড়েছিলাম। লুঙ্গি ষ্টাইলে। শর্ত ছিলো ব্যালকনিতে গিয়েই টাওয়েল খুলে দরজার ফাঁক দিয়ে টাওয়েল ভেতরে ফেলবো। তখন থেকেই এক মিনিট গণনা শুরু হবে। এক মিনিট ষোলো ইঞ্চি পুরো তুষারে খালি পায়ে সম্পূর্ণ ন্যাংটা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে কেমন শীত অনুভূত হয় তা আমার মতো পাগলামি যারা করেছেন তারাই বুঝবেন। আমি বাজিতে জিতেছিলাম।
ডিসেম্বর মাসে তীব্র শীত, তুষারপাত হলেও ইউরোপ আমেরিকা খুব জমাজমাট থাকে। কৃসমাস ডে, নিউ ইয়ার উৎযাপন নিয়ে সারা পশ্চিমা বিশ্ব উৎসবে মেতে উঠে। ড্যানিয়ুব নদীর তীরে প্রতি বছর ডিসেম্বরে একটি কনসার্ট হতো। লাইভ কনসার্ট। খোলা জায়গায় ষ্টেজ করে বিখ্যাত শিল্পীরা গান গাইতেন। কোনো টিকেটের প্রয়োজন ছিলো না। অনেক অস্থায়ী দোকান বসতো নদীর তীরে। আমাদের দেশের মেলার মতো। এই উৎসবের নাম ছিলো জার্মান ভাষায় দোনাও ফেষ্ট (Donau Fest)। ইংরেজিতে ড্যানিয়ুব ফেস্ট ( Daniube Fest)।
ডিসেম্বরের তীব্র শীত উপেক্ষা করে কয়েক হাজার মানুষ তাতে অংশ গ্রহন করতো। ১৯৯৩ সালে দোনাও ফেষ্ট-এ গান গাইতে এসেছিলেন বিখ্যাত শিল্পী এলটন জন, বব মার্লি। সামনা সামনি তাদের গান শোনার সৌভাগ্য হয়েছিলো। যথেষ্ট গরম পোষাক পড়লে ঠান্ডার মধ্যেও বেশ ভালো লাগে। নিঃশ্বাসে টাটকা বাতাস।
কয়েকদিন পর সকাল সাতটায় আমাদের আরেক বন্ধু বাবু ফোন করে জানিয়েছিলো যে, অতিরিক্ত ঠান্ডায় ড্যানিয়ুব নদীর অনেকটা পানি বরফ হয়ে গিয়েছিলো। অনেকেই সেই বরফ হওয়া পানির উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে নদী পার হচ্ছিলো। আমিও বরফ হয়ে যাওয়া পানির উপর দিয়ে হেঁটে ড্যানিয়ুব নদী পার হয়েছিলাম। ইউরোপের আরো অনেক বিচিত্র ঘটনা অন্যদিন বলবো।
এবার চলুন একটু নিউইয়র্ক থেকে ঘুরে আসি। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। রক্ত ঠান্ডা করা শীতের সন্ধ্যা। বিকেল থেকেই পেঁজা তুলার মতো পাতলা তুষার দুলতে দুলতে নামছিলো। বৃষ্টির শব্দ থাকলেও তুষারপাত একেবারে নিঃশব্দ। সাদা হয়ে গিয়েছিলো গাছগুলোর মাথা। শুভ্রতায় ছেয়ে গিয়েছিলো চারদিক। অনেক দিনের চেনা জায়গাগুলো মনে হচ্ছিলো যেনো অপরিচিত। সকালে ঘুম থেকে উঠে জানালা দিয়ে তাঁকিয়ে দেখেছিলাম পুরো নিউ ইয়র্ক সিটি সাদা। সারারাত তুষার পড়েছিলো। এখনো তুষারপাত থামেনি। প্রকৃতি যেনো বিধবার মতো সাদা শাড়ি পরেছে।
সিবিএস টিভি অন করে দেখলাম, ভাষ্যকার বলছেন, তুষার ঝড় হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া জনসাধারণকে ঘরের বাইরে না যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছিলো বার বার। এক ঘন্টা পরই সরকারি ঘোষনা টেলিকাষ্ট করা হচ্ছিলো সবগুলো টিভি চ্যানেলে।
ফেডারেল হলিডে ঘোষনা করা হয়েছে। শুরু হলো তুষার ঝড়। তুষার ঝড়কে ইংরেজিতে বলে ব্লিজার্ড (Blizzard)। তুষার ঝড় হলো আমাদের দেশের কাল বৈশাখির মতো। প্রচন্ড ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে তীব্র তুষারপাত। সেদিন নিউইয়র্কের তাপমাত্রা ছিলো মাইনাস চোদ্দ ডিগ্রি। বন্ধ করে দেয়া হয়েছিলো বিশ্বের ব্যস্ততম জে,এফ,কে (জন এফ কেনেডি) এয়ারপোর্ট। বিশ্বের ব্যস্ততম সিটি, ক্যাপিটাল অফ দি ওয়ার্ল্ড নিউ ইয়র্ক সেদিন ছিলো প্রেতপুরী। জীবনে প্রথম তুষার ঝড় দেখেছিলাম নিউ ইয়র্কে।
কয়েকজন বন্ধুকে ফোন করে বলেছিলাম চল, সবাই বের হয়ে পুরো নিউইয়র্ক সিটি আজ দেখবো কেমন? বদরুল, শাহ আলম, আমি, কামাল আর বুলবুল বেরিয়ে পড়েছিলাম। টিভিতে নিরাপত্তার ঘোষনা উপেক্ষা করে। গায়ে একটা গরম গেঞ্জি, তার উপর লিভাইয়ের জিন্সশার্ট, তার উপর টেরিউলের সোয়েটার, তার উপর মাথা ঢাকা লেদার জ্যাকেট, প্যান্টের নিচে ইনার, তার উপর ডকার্স (ব্রান্ড নেম) প্যান্ট, পায়ে ইটালিয়ান ইউন্টার শু। ঠান্ডা লাগার কোন সম্ভাবনা নেই। যথেষ্ট গরম পোষাক পরলে তুষারের মধ্যেও হাঁটতেও ভালো লাগে।
আমরা সবাই ম্যানহাটন বা নিউইয়র্ক সিটিতে থাকতাম। জাতিসংঘ ভবন, টাইমস স্কয়ার, রকফেলার সেন্টার, বেলভিউ হসপিটাল, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার বা টুইন টাওয়ার যা ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী বিমান হামলায় ধ্বংস হয়েছিলো, সবই দেখেছিলাম তুষার ঝড়ে হাঁটতে হাঁটতে। বৃষ্টির পানিতে শরীর ভিজে যায় কিন্তু গায়ে তুষার পরলে শরীর ভেজে না। মাথার চুলগুলো সাদা হয়ে যায়। হাত দিয়ে ঝাড়া দিলে আবার নরমাল। তুষারগুলো অনেকটা ধুলাবালির মতো। আমরা তুষারের মধ্যে গড়াগড়ি করেছিলাম।
কক্সবাজারে যেমন অনেকেই বালির উপর শুয়ে থাকে আর অন্য বন্ধুরা বালি দিয়ে তাকে ঢেকে দেয় আমরাও নিউইয়র্কের রাস্তার পাশে স্তুপিকৃত তুষারের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলাম। না দেখলে তুষার ঝড়ের বর্ণনা লিখে বুঝনো সম্ভব নয়। দুপুর পর্যন্ত তুষারে খেলা করে বাসায় ফিরছিলাম। ফিফ্থ এভিনিউতে এম্পায়ার ষ্টেট বিল্ডিংয়ের কাছে এক বাসার সামনে বুলবুল স্লিপ করে পড়ে গিয়েছিলো। সঙ্গে সঙ্গে ওই বাসা থেকে স্বামী স্ত্রী বেরিয়ে বুলবুলসহ আমাদের সবাইকে বাসায় নিয়ে গেলেন। কফি খাওয়ালেন। বুলবুল বেশি আঘাত পেয়েছে কিনা জানতে চাইলেন। কিছু ওষুধ দিলেন। পাঁচশো ডলার বুলবুলের হাতে দিয়ে বললেন, বেশি ব্যথা অনুভব করলে চিকিৎসা করতে। আমরা রীতিমতো অবাক হয়েছিলাম। ভদ্র মহিলা অনুরোধ করে বলেছিলেন, যেনো পুলিশকে না জানাই।
আমরা জানতাম, তুষারপাত হলে যার যার বাড়ি ও দোকানের সামনের তুষার বাড়ির মালিক নিজ দায়িত্বে পরিস্কার করে রাখবেন যাতে পথচারীদের চলাফেরায় কোনো সমস্যা না হয়। যদি কোন পথচারী ওই বাসা বা দোকানের সামনের তুষারে স্লিপ করে পরে আঘাত পায় তবে তার চিকিৎসার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করবে ওই বাড়ির বা দোকানের মালিক। এটা ইউরোপ, আমেরিকার আইন। বাংলাদেশের মতো বড়লোকি ইউরোপ আমেরিকায় চলে না। ফোন করলেই পুলিশ এসে ধরবে। যতো বড়লোকই হোক। এসব কারনে পশ্চিমা দেশ আমার ভালো লাগে। বাইরের দেশে ওরা অত্যাচার, শোষণ, নির্যাতন করলেও নিজ দেশে সব সুযোগ সুবিধা, আইনকানুন, মানবাধিকার নিশ্চিত করেছে।
আমরা কফি খেয়ে পাঁচশো ডলার নিয়ে মহিলাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। বুলবুল সিরাজগঞ্জের মাসুমপুর গ্রামের, বদরুল ব্রাক্ষণবাড়িয়ার, কামাল চট্টগ্রামের, শাহ আলম নোয়াখালীর আর আমি কুমিল্লার। বদরুল খুব বেশি ডৃংক করতো। বদরুল বললো, পাঁচশো ডলার দিয়ে শুধু ডৃংকস কেনা হবে। বুলবুল বললো, ব্যথা পেলাম আমি আর মদ খাবা তুমি? শাহ আলম নোয়াখালীর ভাষায় বললো, আঁই কিইচ্ছি? অর্থাৎ আমি কি করেছি? আমিতো মদ খাইনা। আমি কি খাবো? শাহ আলম মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছে। মদমুদ খায় না।
আমরা তখনো ফিফ্থ এভিনিউতে। এবার ঝড়ের মাত্রা আরো বেড়েছিলো। আমরা তখন দৌঁড়াতে শুরু করলাম। থার্ড এভিনিউতে আমার বাসায় ফিরে বুলবুল বললো, করিম আজকের এই ঘটনা নিয়ে আপনি সাপ্তাহিক ঠিকানা বা যায়যায়দিন একটা গল্প লিখবেন। এতোদিন লেখা হয়নি।
১৯৯৯ সালে বুলবুল দেশে ফিরে এসেছিলো। এখন কোথায় জানি না। যোগাযোগ নেই।
ফেসবুক বন্ধুরা শুনবেন নাকি আমার বিদেশের কথা?
হ্যাভ এ নাইস ডে।
Karim Chowdhury
কুমিল্লা থেকে
ডিসেম্বর ২০১৩
karimcbd@gmail.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন