ফাদার্স ডে-র ইতিহাস
করিম চৌধুরী
(আজ বাবা দিবস। তাই পুরনো লেখা আবার।)
আমেরিকায় বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান পালন করা হয়। আমেরিকার মানুষদের কিছু কাজ দেখে আমরা অবাক না হয়ে পারি না। তাদের এই অবাক করে দেয়া কাজকর্ম দেখে আমরা প্রাচ্যের মানুষরা ভাবি ওরা বোধ হয় কিছুটা পাগল। ব্রেনের নাটবল্টু দুই একটা হয়তো নেই। তাদের এসব পাগলামির কিছু অংশ এবার নতুন বছরে দেশের অনেকেই দেখেছেন। সংবাদপত্রের পাঠক মাত্রই লক্ষ্য করেছেন, ইংরেজি নববর্ষে ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত মি. ডেভিড এন. মেরিল তার স্ত্রীকে যাত্রী বানিয়ে নিজে রিকশাচালক সেজে ফটো তুলেছেন। আর সেই কার্ডে ‘রিকশাওয়ালা মেরিল’ নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদেরকে। রাজধানী ঢাকায় কয়েক ডজন বিদেশী রাষ্ট্রদূত থাকলেও পাগলামিটি করতে পেরেছেন শুধু আমেরিকান রাষ্ট্রদূত। তাদের এসব কান্ডকারখানা দেখে অনেকে কৌতুক করে বলেন, ওরা আসলে ফাজিল। শিক্ষিত ও আধুনিক মানুষরা অবশ্য মনে করেন আমেরিকানদের যে চমৎকার সেন্স অফ হিউমার তা দেখেই আমরা নানান যন্ত্রণার পূর্বদেশীয় মানুষরা ভাবি এসবই তাদের পাগলামি কিংবা ফাজলামি। আমাদের দেশে অনেক কিছুর অভাব থাকলেও অন্তত যন্ত্রণার অভাব নেই এতটুকু।
এত যন্ত্রণার দেশের মানুষ হিসেবে আমেরিকানদের সেন্স অফ হিউমার বোঝার মতো সময়ইবা আমাদের কোথায়? অথচ সেন্স অফ হিউমার যে একজন মানুষের একটি বড় মাপের যোগ্যতা তা না লিখলেও চলে। আমাদের ভাষায় এসব পাগলামি কিংবা ফাজলামিতেও আমেরিকানরা বিশ্বে শীর্ষস্থান দখল করে আছে। এর কারণ বোধ হয় আমেরিকানরা খুব বেশি ইনফরমাল। সিরিয়াস একটা কথাও ওরা বলবে রসিকতা করে। জীবনকে উপভোগ্য করে তোলার জন্য যা কিছু প্রয়োজন ওরা সবই করেছে।
প্রেমিক প্রেমিকাদের জন্য তাদের যেমন আছে ভালোবাসা দিবস বা ‘সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে’-মাতৃত্বের প্রতি সম্মান স্বরূপ তেমনি আছে ‘মাদার্স ডে’ বা মা দিবস, বন্ধুর জন্য আছে তাদের 'ফ্রেন্ডশিপ ডে', ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য তাদের আছে ‘থ্যাংকসগিভিং ডে’ বা ধন্যবাদ জ্ঞাপন দিবস, জনপ্রিয় প্রেসিডেন্টদের জন্মদিন উপলক্ষে আছে তাদের ‘প্রেসিডেন্টস ডে’ বা রাষ্ট্রপতি দিবস, প্রবীণদের জন্য আছে তাদের 'ভেটারেন্স ডে, বিভিন্ন যুদ্ধে দেশে বিদেশে যেসব আমেরিকান সেনা মারা গেছেন তাদের স্মরণ করার জন্য আছে তাদের 'মেমোরিয়াল ডে', বাবাদেরকে সম্মানিত করার জন্যও আছে তাদের ‘ফাদার্স ডে’ বা বাবা দিবস।
কর্মসূত্রেই কয়েকজন আমেরিকানের সঙ্গে আমার বেশ ভালো বন্ধুত্ব আছে। দেশের কিছু মুরুব্বির ভাষায় আমিও একটু ফাজিল টাইপ ছেলে। যার সঙ্গে আমার বিশেষ সখ্য তিনি আমার অনেক দিনের চেনা। বয়স চল্লিশোর্ধ। নাম হেনরিখ ফ্র্যাংক। ফ্র্যাংক নামেই তিনি পরিচিত। পড়ালেখা জানা লোক। পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম.এ করেছেন। কথাবার্তায়ও তিনি তার নামের মতোই ফ্র্যাংক। কোনো কিছু জানতে চেয়ে তাকে প্রশ্ন করা মানে রীতিমতো নাজেহাল হওয়া। তবে ভদ্রলোক খুবই রসিক এবং বন্ধু বৎসল। ফাদার্স ডে সম্পর্কে কিছু জানার আগ্রহ নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ফাদার্স ডে-তে আপনার প্রোগ্রাম কি?
ফ্র্যাংক রহস্যজনকভাবে হেসে বললেন, ইয়াং ম্যান, আমি জানি তুমি অবিবাহিত। বিয়ে না করেও এদেশে সন্তানের পিতা হওয়া যায়। এটা আমাদের দেশে স্বীকৃত এবং বৈধ। কিন্তু তুমি এখনো পিতাও হওনি। ফাদার্স ডে নিয়ে তোমার এতো আগ্রহ কেনো? সন্তানের পিতা হওয়ার জন্য যে বিশেষ মানুষটির দরকার তোমার তাও নেই। তুমি বরং ভালোবাসা দিবস নিয়েই ব্যস্ত থাকো। ভালোবাসার সেই মানুষটি পেয়ে গেলে তুমি যে খুব শিগগিরই পিতা হবে তা তোমার মাথাভর্তি চুল আর লোমশ বুক দেখেই বোঝা যায়। তখন ফাদার্স ডে নিয়ে ভেবো। এখন ফাদার হওয়ার জন্য ভাবো।
ছোট্ট এক প্রশ্নের উত্তরে এতগুলো কথা শোনার পর আমিও রসিকতা করে বললাম, তখন তো আমি ‘হাসব্যান্ড ডে’ বা স্বামী দিবস পালনের আন্দোলন করবো।
অট্রহাসিতে ফেটে পড়ে ফ্র্যাংক বললেন,
ক্যারিম, আমি লক্ষ্য করেছি, তুমি যেরকম লোভাতুর দৃষ্টিতে মেয়েদের দিকে তাঁকাও, কিছু না করেও একদৃষ্টিতে অনেকক্ষণ কোনো মেয়ের দিকে তাঁকিয়ে থাকলে তোমার লোভী দৃষ্টিতেই সেই মেয়ে প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়বে। কাজেই তুমি যে হাসব্যান্ড ডে পালনের চেষ্টা করবে তা অন্তত আমি বিশ্বাস করি। তবে তোমার স্ত্রীও বোধহয় ‘ওয়াইফ ডে’ বা স্ত্রী দিবস পালনের আন্দোলনে নামবে।
রসিকতার মাত্রা ছাড়িয়ে এবার আমি বললাম, ওয়াইফ ডে বা স্ত্রী দিবস তা হতেই পারে না। স্বামীরা তা কিছুতেই মানবেন না। যদি হয় তবে সেটা হবে ‘ওয়াইফ নাইট’ বা স্ত্রী রজনী। সারা বিশ্বের স্বামীরা অপেক্ষায় থাকবেন সেই বিশেষ রজনীর জন্য। বছরের একটি বিশেষ রাতে দুনিয়ার তাবৎ স্বামীরা তাদের স্ত্রীদেরকে অভিনন্দিত করবে বিশেষভাবে।
হাসতে হাসতে ফ্র্যাংক বললেন, তুমি দেখছি আমার চেয়েও ফানি।
শোনো ক্যারিম, একটা নতুন আইডিয়া আমার মাথায় খেলেছে। প্রত্যেকের জন্যই একটি বিশেষ দিন থাকা দরকার। ভাইদের জন্য ‘ব্রাদার্স ডে’, বোনদের জন্য ‘সিষ্টার্স ডে’, ভাতিজা ভাগ্নেদের জন্য ‘নেফিউ ডে’, ভাইঝি বোনঝিদের জন্য ‘নীস ডে’, সহকর্মীদের জন্য ‘কলিগ ডে’, অফিসের কর্তাদের জন্য ‘বস ডে’, তেমনিভাবে শ্বশুর শাশুড়ি, শ্যালক শ্যালিকা অর্থাৎ প্রত্যেকের জন্যই একটি করে দিন। তাহলে বছরের প্রতিদিনই কোনো না কোন অনুষ্ঠান থাকবে ।
হাসতে হাসতে গম্ভীরভাবে বললাম, ফ্র্যাংক, ডোন্ট বি ফানি। লেটস কাম টু দি পয়েণ্ট। আমি আসলে আপনার কাছে কিছু তথ্য জানতে চাই। ফাদার্স ডে সম্পর্কে কিছু বলুন। প্লিজ নো মোর ফান। আই অ্যাম সিরিয়াস।
ফ্র্যাংক বললেন, অলরাইট, শোনো। ওয়াশিংটন রাজ্যের (ওয়াশিংটন ডিসি যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী। ওয়াশিংটন ষ্টেট ওয়েষ্ট কোষ্টে কানাডার ভ্যাংকুভারের সঙ্গে) স্পোকেইন সিটির সনোরা লুইস স্মার্ট ডড (Sonora Luis Smart Dod) নামের এক মহিলা সর্বপ্রথম তার পিতাকে সম্মানিত করার জন্য ১৯০৯ সালে ফাদার্স ডে পালনের চিন্তা করেন। তার পিতার নাম ছিলো উইলিয়াম জ্যাকসন স্মার্ট। স্মার্টের স্ত্রী মারা যান ১৮৯৮ সালে। স্মার্ট দ্বিতীয়বার আর বিয়ে করেননি। তিনি যত্নের সঙ্গে তার ছয় সন্তানকে বড় করেন। সনোরা লুইস স্মার্ট পিতার এই স্যাক্রিফাইস দেখে অভিভূত হন এবং বাবাকে বিশেষভাবে সম্মানিত করার জন্য ন্যাশনাল ফাদার্স ডে পালনের অনুরোধ জানিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে লিখিত আবেদন জানান। স্পোকেইন সিটি প্রশাসন এবং লোকাল ইয়াংম্যানস ক্রিশ্চিয়ান অ্যাসোসিয়েশন এই উদ্যোগকে সমর্থন দেন। সনোরার উদ্যোগেই সর্বপ্রথম স্পোকেইন সিটিতে ফাদার্স ডে পালন করা হয় ১৯১০ সালের ১৯ জুন তারিখে। এরই মাঝে বহু বছর কেটে গেছে। দিনটিকে জাতীয়ভাবে পালনের জন্য বহু প্রস্তাবও পাস হয়েছে।
শেষ পর্যন্ত ১৯৭২ সনে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড এম. নিক্সন সেই প্রস্তাবে সই করে ফাদার্স ডে বা বাবা দিবসকে জাতীয়ভাবে পালনের আইনগত বৈধতা দেন। যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় প্রতি বছর জুন মাসের তৃতীয় রবিবার যথাযোগ্য মর্যাদায় আমরা ফাদার্স ডে পালন করি।
যে তথ্যগুলো জানার জন্য কাজে ফাঁকি দিয়ে এতোক্ষণ গল্প করা-আমি তা জেনেছি।
ফ্র্যাংককে বড় করে একটা ধন্যবাদ দিলাম। প্রত্যুত্তরে সে ইউ আর মোষ্ট ওয়েলকাম। টেক কেয়ার মাই ফ্রেন্ড, বলে বেরিয়ে গেলো।
© Karim Chowdhury
১০. ০৬. ১৯৯৭
নিউ ইয়র্ক থেকে
(''বাবা' নিয়ে যায়যায়দিন-এর বিশেষ সংখ্যায় এই লেখাটি লিখেছিলাম ১৯৯৭ সালে নিউ ইয়র্ক থেকে। এডিটোরিয়াল বোর্ড লেখাটি কভার স্টোরি হিসেবে ছেপেছিলেন। ম্যাগাজিনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখা কভার স্টোরি বা প্রচ্ছদ কাহিনী হিসেবে ছাপা হয়। ফেসবুকে মানুষ এগুলো পড়ে না। পাঠকদের মধ্যেও শ্রেণি বিভাগ আছে। এই লেখাটি প্রকাশিত হবার পর ম্যাগাজিনে সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হিসেবে আত্নপ্রকাশ করেছিলাম।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন