২টা মা=১টা মামা
--------------------------
একেবারেই ব্যক্তিগত। ইদানীং স্কুল কলেজ জীবনের কথা খুব মনে পড়ে। ছবিতে আমার মেজো আপা। দুই দিকে দুই ভাগ্নি। আপার নাম ফিরোজা বেগম। বাসা কান্দিরপাড়। শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে। আপার পাঁচ মেয়ে এক ছেলে। নাজমা, ঝর্ণা, পান্না, শিল্পি, লাভলি। একমাত্র ছেলে শাহিন। সবার ছোট। আমার স্কুল-কলেজ জীবন আপার বাসায়ই কেটেছে। দুলাভাই মি.দেলোয়ার হোসেন সরকার দারুণ মজার মানুষ। শৌখিন, ফানি, ফ্রেন্ডলি। দুলাভাই টঙ্গীর অলিম্পিয়া টেক্সটাইল মিল- এ পারচেজ অফিসার ছিলেন। তাই অভিভাবক হিসেবে আমাকে আপার বাসায় থাকতে হয়েছে। কারণ বাসায় পুরুষ বলতে কেউ নেই। শাহিন খুব ছোট। আজ দুই ভাগ্নিকে নিয়ে একটু স্মৃতি।
নাজমা, ঝর্ণা আমার অল্প ছোট। আমার সঙ্গে ওদের সম্পর্ক ছিলো বন্ধুর মতো। কখনো ভাইয়ের মতো। ওদেরকে ভালোওবাসতাম খুব। ঝগড়া করতাম, রাগারাগি করতাম, মারামারিও করেছিলাম। বলা যায়, আমি বড় হয়েছি ওদের সঙ্গে। প্রেম ট্রেম নিয়ে ওদের শাসন করলে অন্য রুম থেকে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতো, নিজে প্রেম করে আবার আমাদের মারে!
সবার বিয়ে হয়ে গেছে। ঘর সংসার নিয়ে ব্যস্ত। সকলেই কুমিল্লা শহরে থাকে। শিল্পি আমেরিকায় স্বামীর সঙ্গে। আপার বাসায় মাঝে মাঝে গেলেও ভাগ্নিদের বাসায় যাওয়াই হয় না। দু’দিন আগে ফেইসবুকে দেখি শাহনাজ পারভীন ঝর্ণা নামে একজন। তার টাইমলাইনে গিয়ে কিছু ছবি দেখলাম। সবার গ্রুপ ছবি পাইনি। এই ছবিতে একদিকে ঝর্ণা আরেক দিকে দাঁড়িয়ে লাভলি মাঝে আপা। ছবিটা ঝর্ণার ওয়াল থেকে নিয়েছি। ছবিটা কক্সবাজারে। আমার অতীত স্মৃতি মনে পরে গেলো।
ঝর্ণার সঙ্গে আমার একটা ছোট্ট স্মৃতি এমন...
কলেজ জীবনে সবসময় পকেটে টাকা থাকতো না। ঝর্ণা তখন কুমিল্লার নামজাদা মেয়েদের স্কুল, ফয়জুন্নেসা গভর্মেন্ট গার্লস স্কুল-এ পড়তো। অন্য মেয়েদের মতো ঝর্ণাও টাকা জমিয়ে বইয়ের মধ্যে রাখতো। আমার টাকার শর্ট পড়লেই ঝর্ণার কাছে ধার চাইতাম। প্রথমে বলতো, 'নাই মামা, সইত্য আমার কাছে টাকা নাই, আমার কাছে টাকা আসবো কইত্থাইকা মামা?'
আমি বুঝিয়ে বলতাম, দেখ, তুই যদি ১০০ টাকা আজ দিস তবে আগামি সপ্তাহে তোকে ১২০ টাকা দেবো। ২০ টাকা লাভ। দেখলাম সে নিম রাজি। আরেকটু পাম্প দিতে হবে। বুঝালাম, দেখ-দুইটা ‘মা’ একসঙ্গে করলে একটা 'মামা' হয়। মামার মনে কষ্ট দিতে নাই। দুইটা মায়ের সমান একটা মামা। সেভেন এইটে পড়ুয়া ঝর্ণা খুব চিন্তায় পড়ে যেতো। এক পর্যায়ে সে রাজি হতো। শর্ত আগামি সপ্তাহে ১২০ টাকা দিতে হবে। দেবো কিনা সেজন্য আমাকে 'আল্লাহর কসম', 'বিদ্যা' এসব কসম কাটতে হতো। এভাবে মাস দুয়েক লেনদেন চলেছিলো। একবার এক সপ্তাহের টাকা আমি সময় মতো দিতে পারিনি। পাওনাদার ঘরের লোক। লুকিয়ে থাকার কোনো রাস্তা নেই। সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা, রাতে ঝর্ণা টাকার জন্য চাপ দিতে লাগলো। একদিন এই ঘরের পাওনাদের ভয়ে আমি রাতে দেরিতে বাসায় গেয়েছি যাতে সে ঘুমিয়ে পড়ে।
সকালে ঘুমের মধ্যে এসে ডেকে ঝর্ণা তার টাকা চাইলো। ঘুম থেকে উঠে রেগে গিয়ে বললাম, হ্যাঁ, তুই একটা ছোটলোক। তুই সুদ খাস আরো বড় বড় কথা বলিস। টাকা নিয়েছি দেবো। এখন নাই। বেশি ঘ্যান ঘ্যান করলে দেবোই না। সে খুবই মনঃক্ষুণ্ণ হলো। ভয়ও পেলো যদি টাকা না দিই।
কয়েকদিন পর তাকে টাকা দিয়ে দিই। ইন্টারেস্টসহ।
মাস খানেক পর আমার আবার টাকার দরকার হয়। ঝর্ণার কাছে ধার চাইতেই সে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বললো, না মামা, আমার কাছে কোনো টাকা নাই। আবার অনুনয় বিনয় করে বলতেই ঝর্ণা রেগে আমাকে বলে ... 'আমার কাছে আছে, আপনেরে দেমু না। না মামা, আপনে টাকা নেয়ার সময় অনেক পাম দেন। দুইটা মা মিলে একটা মামা হয় এমন কথা বলে আমার মন নরম করেন। কতো অনুনয় বিনয়! আর টাকা ফেরত চাইলে আপনে চোখ উল্টাইয়া ফেলেন। আমারে সুদখোর কন! আমি আর জীবনেও আপনেরে টাকা দেমু না। আমার সুদ লাগবো না।'
মাঝে মাঝে আপা ডেকে বলতেন-তোরা কি শুরু করছোস? সেই ঝর্ণার বড় মেয়ে প্রমি এখন মিডল্যান্ড হসপিটালে মেডিকেল অফিসার। আর ছোট মেয়ে প্রীতু নর্থ সাউথে পড়ে। নাজমার দ্বিতীয় মেয়ে 'সাবিহা ইফেল'ও নর্থ সাউথে পড়ে।
লোকে বলে আমার ভাগ্নিরা সুন্দরী। সবার গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা। শুধু লাভলীর গায়ের রঙ শ্যামলা। লাভলীকে আদর করে রাগানোর জন্য 'কালী মা' ডাকতাম। লাভলী হাত নেড়ে আঙুল উঁচিয়ে কিশোরীর চপলতায় বলতো- কালী মা বলেন আপত্তি নাই। কালী হলেও সুইট আছি।
সময় কতো দ্রুত চলে যায়! মনে হয় যেনো সেদিনের কথা।
© Karim Chowdhury
30 April, 2022
Cumilla.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন