পুলিশের ভাবমূর্তি -
------------------------
পুলিশের চাকরি একটা অত্যন্ত সম্মানজনক চাকরি। পুলিশকে মানুষ যেমন ভালোবাসে তেমনি শ্রদ্ধাও করে। সাধারণ মানুষ কেউ পুলিশকে ভয় পায় না। সকলেই পুলিশকে বন্ধু মনে করে। যে কোনো বিপদ আপদে পুলিশই একমাত্র ভরসা। উন্নত দেশগুলোতে তাই দেখেছি।
একবার এক চেকোস্লোভাকিয়ার বান্ধবী ক্যাথারিনা ভিয়েনা বেড়াতে এসে কয়েকদিন থেকে, যাওয়ার সময় আবদার করলো আমি যেনো তার সঙ্গে চেকোস্লোভাকিয়া আরেকবার যাই। তার বাসা অস্টৃয়া-চেকোস্লোভাকিয়ার বর্ডার সিটিতে। শহরটির নাম ব্রুনো BRNO. এই শহরটি অর্ধেক অস্টৃয়ায় আর অর্ধেক চেকোস্লোভাকিয়ায়। শহরটি আরো বিখ্যাত এইজন্য যে, জার্মান ডিক্টেটর এ*ড*লফ হি*ট*লা*রের জন্ম এই শহরে অস্টৃয়ার অংশে। হি*ট*লারের শৈশব কেটেছিলো এই শহরে। ভিয়েনা থেকে বাসে মাত্র দেড় ঘন্টার জার্নি।
আমি ক্যাথারিনাকে বুঝিয়ে বললাম, আগেরবার যে চেকোস্লোভাকিয়ায় গিয়েছি সেই ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এখন তোমার সঙ্গে যেতে হলে আমার আবার চেক ভিসা নিতে হবে। ভিসা নেয়া আমার জন্য কোনো সমস্যা ছিলো না। চেক এম্ব্যাসিতে গেলেই ভিসা দেবে সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু সেদিন এই ঘটনা ঘটে রাত ৯ টায়। তাই এম্ব্যাসি বন্ধ। সে বললো, সে ইমিগ্রেশন পুলিশকে বুঝিয়ে বলবে যে আমি তার বন্ধু। আমি তার বাসায় যাবো অতিথি হিসেবে।
আমি বললাম, শুনো কাতকা, (ক্যাথারিনার সংক্ষেপ নাম) তুমি কেনো? তোমার বাবা এসে ইমিগ্রেশন পুলিশকে বুঝালেও কাজ হবে না। এটা সরকারের পররাষ্ট্রনীতি। আমার সঙ্গে তোমার বিয়ে দিয়েও ভিসা ছাড়া তোমার দেশে আমাকে নিতে পারবে না। আমিও পারবো না ভিসা ছাড়া তোমাকে আমার দেশে নিতে।
মেয়েটি ইঞ্জিনিয়ার। প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্কিটেক্ট হয়ে সদ্য বের হয়েছে। ২৪/২৫ বছর বয়স। কিন্তু রাজনীতি সম্পর্কে তার কোনো জ্ঞান নেই। সমাজতন্ত্র থাকা কালে প্রায় সব চেক সিটিজেনের মতো সেও কোনো দিন বিদেশ যায়নি। তাদের ঘরের কাছে অস্টৃয়া, জার্মানিতেও যায়নি। যাদের সঙ্গে চেকোস্লোভাকিয়ার রয়েছে দীর্ঘ স্থলসীমান্ত। সমাজতন্ত্রে যে কোনো নাগরিকের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা ছিলো। অনেকেরই মনে থাকার কথা সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) পদার্থ বিজ্ঞানী আঁনদ্রে শাখারভ পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেলেও ব্রেজনেভ শাসনামলে তাকে সুইডেন যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি। শাখারভ উপস্থিত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করতে পারেন নি।
এতো সব বুঝিয়েও ক্যাথারিনাকে বুঝাতে পারিনি। চেকোস্লোভাকিয়ায় ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে সে আমার ফ্রিজ খোলে আগেই আধা বোতল র জনি ওয়াকার ব্ল্যাক লেবেল হুইস্কি খেয়ে ঝিম ধরে বসে আছে। বন্ধু বাবু বললো, এতো করে বলছে যখন যাও না। ইমিগ্রেশন থেকে আবার ফিরে এসো। সময় তো বেশি লাগবে না। রাত বাজে ১০টা মাত্র। আমি বাবুকে বললাম, এটা একটা কথা হলো বাবু? রাত বাজে ১০টা। আমার নেই চেক ভিসা। কাতকা হুইস্কি খেয়ে মাতাল। ( কিন্তু সে কোনো মাতলামি করেনি। বয়স কম বুঝে না।)। তার সঙ্গে এই শীতের রাতে আমি বর্ডার পর্যন্ত যাবো আবার আসবো? বাইরের তাপমাত্রা দেখেছো? মাইনাস ১২ ডিগ্রি। বাবু ইয়ার্কি করে বললো, এক ফোঁটাও শীত লাগবে না। এদেশের বাসাবাড়ির মতোই বাস, ট্রেন, কার সবই হিটিং সিস্টেমে গরম থাকে। আর সুন্দরী কাতকা তো পাশেই বসবে। শেষমেশ প্যান্ট, শার্ট, জুতা, জ্যাকেট, হাত মোজা পরে রেডি হলাম। জানি ফিরে আসবো।
ভিয়েনা থেকে চেকোস্লোভাকিয়াগামী বাসে উঠেই কাতকা আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুম। সমাজতান্ত্রিক দেশের লোকেরা বেশি ডৃংক করে। তাদের কমন ডৃংক ছিলো কমদামী রাশিয়ান ভদকা। আমার ফ্রিজে দামী স্কচ হুইস্কি পেয়ে বরফ, কোক, সোডা ওয়াটার এসব কিছু না মিশিয়েই ঢকঢক করে আধা বোতল হুইস্কি খেয়ে ফেলেছিলো। তাই ঘুম না, ঝিম ধরে আছে আমার কাঁধে মাথা রেখে। আধা বোতল র হুইস্কি খাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। গ্লাসেও ঢালেনি। তাও আস্তে ধীরে খেলে হতো। বোতল খোলেই মুখে লাগিয়ে অর্ধেক বোতল সাবার করে ফেলেছে।
আমিও আর তাকে ডিস্টার্ব করিনি। কতো যে নাটক জীবনে দেখলাম!
ইমিগ্রেশনে এসে বাস থামতেই ইমিগ্রেশন পুলিশ বাসে উঠে ভিসা চেক করছিলো। ইউরোপে এক দেশ থেকে আরেক দেশে বাসে, কারে, ট্রেনে যেতে নামতে হয় না। ইমিগ্রেশন পুলিশই বাসে, ট্রেনে উঠে ভিসা চেক করে। প্রাইভেট কারে গেলে তো গাড়ি থেকেই পাসপোর্ট দেখানো যায়। ইউরোপে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে হাইওয়ের যেখানটায় ইমিগ্রেশন সেই জায়গাটিকে বলা হয় ফ্রন্টিয়ার ক্রসিং Frontier Crossing.
ইউকে ছাড়া ইউরোপের সব দেশে সড়ক পথে যাওয়া যায়।
ইমিগ্রেশনে এলে আমি কাতকাকে ডেকে ঘুম থেকে তুলি।
ইমিগ্রেশন পুলিশ আমার পাসপোর্ট দেখে ভিসা নেই বলে আমাকে নামতে বলে। সঙ্গে কাতকাও নামে। আমি ইমিগ্রেশন পুলিশকে কিছু বলিনি। কাতকা অনেকক্ষণ ধরে ইমিগ্রেশন পুলিশের সঙ্গে কথা বললো। এদিকে বাস দাঁড়িয়ে আছে আমাদের জন্য। রাত তখন ১টা।ডিসেম্বর মাস। তীব্র শীত। শেষমেশ কাতকা, পুলিশ দুজনেই আমার কাছে ক্ষমা চাইলো। পুলিশের সামনেই আমাকে জড়িয়ে ধরে কাতকা চুমুও খেলো। আমি শুধু নাটক দেখছি। বাসে উঠে গেলে কাতকাকে বিদায় জানালাম।
এবার পুলিশ আমাকে নিজে থেকেই বললো, তুমি চিন্তা করো না। এখন এতো রাতে ভিয়েনায় ফিরে যাওয়ার ট্যাক্সি তুমি পাবে না। আমরা ব্যবস্থা করছি তোমার নিরাপদ ফিরে যাওয়ার। আমাকে কষ্ট দেয়ার জন্য দু:খ প্রকাশ করলেন।
ইউরোপে দিন রাত নেই। শতশত প্রাইভেট কার অস্টৃয়া থেকে চেকোস্লোভাকিয়ায় যাচ্ছে। চেকোস্লোভাকিয়া থেকে অস্টৃয়া ঢুকছে।
চেকোস্লোভাকিয়া থেকে অস্টৃয়ায় ঢুকে এমন প্রতিটি প্রাইভেট কার থামিয়ে পুলিশ দেখছে কোনো সীট খালি আছে কিনা? ১০/১২ টা কার চেক করার পর একটা ভলভো (Volvo) কার পাওয়া গেলো। সুইডেনের তৈরি দামী গাড়ি। খালি গাড়ি। মালিক নিজেই ড্রাইভ করছেন। পুলিশ জানতে চাইলেন, তিনি ভিয়েনায় যাবেন কিনা? হ্যাঁ সূচক জবাব দিলে আমাকে ভিয়েনায় বাসায় পৌঁছে দেয়ার অনুরোধ করেন পুলিশ। ভদ্রলোক সানন্দে রাজি হয়। আমি সামনেই ডান দিকে বসি। ইউরোপে লেফট হ্যান্ড ড্রাইভ। কাজেই ড্রাইভার বাম দিকে।
সেই প্রথম আমি কোনো গাড়ির স্পিডোমিটার ডিজিটাল দেখেছি। গাড়ি যতো মাইল বেগে চলছে ততো লেখা উঠে। মিটারের কাঁটা টাটা নেই।
রাত তিনটায় ভদ্রলোক আমাকে ভিয়েনা বাসার সামনে নামিয়ে দেন। তাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। ভদ্রলোকের নাম ছিলো গ্রাহাম।
আমাদের দেশের পুলিশ এইটুকু করবে? সঙ্গে যা কিছু ছিলো টাকাপয়সা, ঘড়ি এসব রেখে দিয়ে উল্টো মামলা দিয়ে দেবে।
দেখলাম তো, দেশ স্বাধীনের পর ৫২ বছর পুলিশের কর্মকাণ্ড। পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও এদেশের সন্তান। তারাও কারো ভাই, কারো ছেলে, কারো স্বামী, কারো বাবা, কারো প্রেমিক, কারো মামা, চাচা, ফুফা।
তবুও আমরা কেনো তাদের অপছন্দ করি? তাদের সঙ্গে তো আমাদের কোনো শত্রুতা নেই। ছোট একটা দেশ। খোঁজ নিলে দেখা যাবে কোনো না কোনোভাবে তারাও আমাদের আত্নীয়। 'পুলিশ' শব্দটা একটা গালি হয়ে গেছে। যে দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মানুষ অপছন্দ করে তাদের অন্যায় কাজের জন্য সেদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে কিভাবে?
আমেরিকায় পুলিশ সাধারণ মানুষকে স্যার বলে সম্মোধন করে।
আমেরিকা থেকে ফিরে এসে বিয়ে করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আমার ছোট আপা ফরিদা একদিন ফোন করে বললেন, তোর তো মাধুরী দীক্ষিতকে পছন্দ। একটা মেয়ে পেয়েছি খুবই সুন্দরী, দেখতেও মাধুরীর মতো। তোর পছন্দ হবে। তাদের বলেছি, আগামীকাল বিকেলে আমরা মেয়ে দেখতে আসবো। তাদের বাসা শহরের বাদুরতলা। আমি আপাকে বললাম, এভাবে তো মেয়ে দেখা ঠিক না। যদি পছন্দ না হয় তাহলে তো বিয়ে করবো না। তখন মেয়েটা মনে বিরাট কষ্ট পাবে৷ ভাববে আমাকে ছেলের পছন্দ হয়নি। সে খুবই হীনমন্যতায় ভুগবে। এটা একটা মেয়ের জন্য বিরাট আঘাত। অপমান।
আপা বললেন, আরে তোর পছন্দ আমি জানি না? মেয়ে তোর পছন্দ হবেই। আমি বললাম, আচ্ছা। পরদিন বিকেলে মেয়ে দেখতে যাওয়ার কথা। সকালে আমার মনে হলো, আরে মেয়ের বাবা কি করেন আপাকে জিজ্ঞেস করি। ফোন করে আপাকে জিজ্ঞেস করতেই আপা বললেন, পুলিশ অফিসার। আমার মাথায় রক্ত উঠে গেলো। আপাকে বললাম, তুমি কোন আক্কেলে পুলিশের মেয়ে দেখেছো আমার জন্য? পুলিশকে আমি আব্বা ডাকতে পারবো না। তুমি এপোয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল করো। আমি পুলিশ অফিসারের মেয়ে বিয়ে করবো না।
আপা বললেন, আজ বিকেলে যে যাবো বলে কথা দিয়েছি। আমি বললাম, ফোনে বলে দাও, আমার এক বন্ধু আজ আমেরিকা থেকে আসবে। তাই তাকে রিসিভ করতে আমাকে এয়ারপোর্ট যেতে হবে। কবে আসবো তা পরে জানাবো আপনাদের।
প্রায় দুই লাখ পুলিশ সদস্যের প্রতি আবেদন, আমাদের এই মানসিকতা আপনারা আপনাদের কাজ দিয়ে ধ্বংস করে দিন। প্লিজ।
থ্যাংক ইউ।
Karim Chowdhury
31 August, 2023
Cumilla.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন