যায়যায়দিন - মৌচাকে ঢিল: লেখালেখির ভালোবাসা
---------------------------------------------------------------------
বিতর্ক যতোই থাক। বাংলাদেশের ইতিহাসে শফিক রেহমান সম্পাদিত সাপ্তাহিক যায়যায়দিন সবচেয়ে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ছিলো। বিতর্ক কেনো তা পরে লিখছি।
১৯৮৪ সালের অক্টোবর মাসে প্রথম প্রকাশিত হয়। দাম ছিলো ৩ টাকা। তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ, ছাত্রছাত্রী, রাজনীতিদিন সকলের কাছেই সমান জনপ্রিয় ছিলো ম্যাগাজিনটি। বিশেষ করে আধুনিকমনস্ক মানুষের কাছে বিপুল জনপ্রিয় ছিলো ম্যাগাজিনটি। রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাত সব দলের কাছেই সমান জনপ্রিয় ছিলো। বাংলাদেশে নিউজপ্রিন্ট দিয়ে প্রচ্ছদ পাতা একমাত্র যায়যায়দিন'ই করেছিলো।
বাঘা বাঘা লেখক সাংবাদিকরা লিখতেন যায়যায়দিনে।
'স্বদেশ' কলাম লিখতেন তারিখ ইব্রাহিম। সপ্তাহের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ। দারুণ লিখতেন তিনি। তারিখ ইব্রাহিম তাঁর ছদ্মনাম। তিনিই বিভুরঞ্জন সরকার। 'তৃতীয় মত' কলাম লিখতেন খ্যাতিমান সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী। 'দেশ দেশান্তর' লিখতেন পররাষ্ট্র সচিব ফারুক চৌধুরী, 'দিনের পর দিন' লিখতেন সম্পাদক শফিক রেহমান। আরো কিছু কলাম ছিলো। 'প্রেসনোট' সপ্তাহের সব পত্রিকার নিউজ নিয়ে আলোচনা। 'খ্যাতির শিখরে প্রেমের গভীরে' পৃথিবীর বিখ্যাত লোকদের রাজনৈতিক, পেশাগত জীবন ও তাদের প্রেম নিয়ে। জন এফ কেনেডি থেকে এলিজাবেথ টেলর, মেরিলিন মনরো পর্যন্ত। 'সমকাল' বিভাগে বিভিন্নজন লিখতেন। আমিও লিখেছি।
নব্বই দশকে 'নির্বাচিত কলাম' লিখতেন তসলিমা নাসরিন। আরো অনেক নামজাদা কলাম লেখক যায়যায়দিনে লিখতেন। আমার তীব্র ইচ্ছা ছিলো যায়যায়দিনে লিখবো। ১৯৯৫ সালে নিউইয়র্ক থেকে শুরু করলাম যায়যায়দিনে লেখা। ২০০৬ পর্যন্ত লিখেছি। পরে দৈনিক হয়ে যাওয়ায় কিছু সময় বিরতি দিলাম। আমি তখন দেশে। কুমিল্লায়। একদিন সম্পাদক শফিক রেহমান ফোন করে বললেন, তারই সম্পাদিত 'মৌচাকে ঢিল' ম্যাগাজিনে লেখা দিতে। এও বললেন, মন্টু, তোমার লেখা পাঠক পছন্দ করে। মেয়ে পাঠকরা তো তোমার বিরাট ভক্ত। শফি ভাইয়ের কথা ফেলতে পারিনি। মৌচাকে ঢিলেও লিখলাম ৫ বছর।
যায়যায়দিন বিতর্কিত হয় প্রধানত দুটো কারনে।
প্রথমত ১৯৯৩ সালে যায়যায়দিন-এর মাধ্যমে শফিক রেহমান এদেশে 'ভালোবাসা দিবস' বা সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে পালন চালু করেন। ভালোবাসা দিবসের সংখ্যায়ও নামীদামী লেখকরা লিখতেন। আমিতো প্রতি সংখ্যায়ই লিখতাম। বিবিসি ও ভয়েস অফ আমেরিকার সাংবাদিক আতাউস সামাদ, রয়টার্স সাংবাদিক আতিকুল আলমসহ আরো অনেককেই লিখতেন। তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ,বৃদ্ধা রোমান্টিক সব মানুষের কাছেই ভালোবাসা দিবস গ্রহণযোগ্যতা পায়।
কিন্তু বাংলাদেশের এক শ্রেণির উগ্রবাদী মুসলিম ভালোবাসা দিবস প্রচলনে বিরোধিতা শুরু করে। তাদের কথাবার্তায় মনে হয় ১৯৯৩ সালের আগে দেশে প্রেম, ভালোবাসা ছিলো না! পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে প্রেম ভালোবাসা ছিলো। লাইলী-মজনু, শিরি- ফরহাদ, ইউসুফ- জুলেখার প্রেম কাহিনী আমরা জানি। আবদুল আলীমের গান আছে
" প্রেম কইরাছেন ইউসুফ নবী- সেই প্রেমে জুলেখা বিবি গো"।
নবীরাও প্রেম করেছেন।
আমি নিজেও প্রেম করেছি আশির দশকে। তখন তো যায়যায়দিন ছিলো না।
দ্বিতীয়ত বিতর্কিত হয় ২০০০ সালে। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে সম্পাদক শফিক রেহমান বিএনপিকে ভোট দেয়ার জন্য নিজ নামে দীর্ঘ সম্পাদকীয় লিখেন। আমি আমেরিকা থেকে ফোন করে সম্পাদকের এই সম্পাদকীয় লেখা নিয়ে তার সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করি। শফিক রেহমানের একটা বিশেষ গুন তিনি ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা করতেন।
লেখালেখির মাধ্যমে পরিচিত হয়ে যায়যায়দিন পরিবারের সঙ্গে আমার গভীর ঘনিষ্ঠতা হয়ে যায়। সম্পাদক আমাকে ডাক নামে কখনো মন্টু, কখনো মিস্টার চৌধুরী ডাকতেন। উনার স্ত্রী তালেয়া রেহমান আমাকে সব সময় মন্টু নামেই ডাকতেন। সহকারী সম্পাদক স্বদেশ রায়, গবেষণা সহকারী সজীব ওনাসিন, তার স্ত্রী তানিয়া, প্রেসনোট কলাম লেখক ডাক্তার সাখাওয়াত হোসেন সায়ন্থ ( বর্তমানে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও নিয়মিত টক শো আলোচক) সকলেই আমাকে মন্টু ভাই ডাকতেন। বর্তমানে নিউইয়র্ক প্রবাসী Lovloo Reza ও যায়যায়দিনে ছিলেন। গত বছর দেশে এসে তার বোনের বিয়েতে আমাকে দাওয়াত দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি যেতে পারিনি। লাভলুও আমাকে এখনো মন্টু ভাই ডাকেন। এরা সকলেই আমার জুনিয়র।
এরশাদ সরকারের আমলে যায়যায়দিন দুইবার নিষিদ্ধ করা হয়। সম্পাদককে দেশ থেকে বহিষ্কার করে লন্ডন পাঠিয়ে দেয়া হয়। ওই সময়ই প্রথম জাতীয় সংসদে ৩০০ আসনের মধ্যে ৩০টি সংরক্ষিত মহিলা আসন করা হয়। এই নিয়ে যায়যায়দিন প্রচ্ছদ কাহিনী ছাপে
" সংসদের শোভা ত্রিশ সেট অলংকার"। এরশাদ সাহেব সংখ্যাটি নিষিদ্ধ করে সম্পাদককে দেশ থেকে বহিষ্কার করেন।
সাপ্তাহিক যায়যায়দিনে লিখে আমি বিপুল জনপ্রিয়তা পাই এবং বাংলাদেশের সব জেলায় আমার পাঠক বন্ধু আছেন। তাদের কেউ কেউ আজো আমার কথা মনে রেখেছেন।
কিছুদিন হয় আমার বন্ধু লিস্টে এসেছেন Dil Hasin Minu. আমরা সমবয়সী। তিনি ২৮ বছর আগের যায়যায়দিন রেখে দিয়েছেন যাতে আমার লেখা আছে। আমাকে তিনি ইনবক্সে আমার লেখার ছবি পাঠিয়ে লিখেছেন, ' করিম চৌধুরীকে পেয়ে গেছি'।
২০১২ সালে মৌচাকে ঢিল ম্যাগাজিনের প্রতারণা বিশেষ সংখ্যায় আমার 'ভেলভেট প্রতারণা' লেখাটি প্রকাশিত হলে ফেনি ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যাপক Mh Fazlul Hoque আমাকে মেসেজে লিখেন...
'ভাই আপনি এতো ভালো লিখেন কিভাবে?' তিনিও আমার বন্ধু লিস্টে আছেন। তিনিও আমার জুনিয়র।
২০১৩ সালে ফাল্গুনী ভালোবাসা সংখ্যায় আমার 'ভালোবাসার গান' প্রকাশিত হলে মাহজাবিন লিজা তো রীতিমতো আমার প্রেমে পড়ে যায়। যায়যায়দিন ও মৌচাকে ঢিল ম্যাগাজিনের সম্পাদকীয় নীতিমালা অনুযায়ী লেখকের ফোন নাম্বার ও কোথা থেকে লিখেছেন তা লেখার শেষে উল্লেখ করা হতো। ফলে যেকোনো পাঠক ফোন ও এসএমএস করতে পারতেন লেখককে। ফোনের যন্ত্রণায় ওই নাম্বারটি আর ব্যবহার করি না। ওই সময় যে জিপি নাম্বার ব্যবহার করতাম তা ছিলো 01718573707. নাম্বারটি আমার নামেই রেজিষ্ট্রেশন করা। খোলে রেখে ছিয়েছি।
আমার লিস্টে আছে Urmila Khatun. ঠাকুরগাঁওয়ের মেয়ে। শিক্ষিকা। আমার অনেক জুনিয়র। আমি তাকে স্নেহ করি। উর্মি আমাকে জানিয়েছে তার খালা আমার পাঠক। খালার কাছেই আমার কথা শুনেছে। মৌচাকে ঢিলে লিখে Mahzabin Liza, Sabrina Mahzabin, ব্র্যাক ব্যাংক কর্মকর্তা Shahed Md Sharif সহ অনেকেই আমাকে ফেইসবুকে পেয়ে অনেক খুশি।
এসব ভালোবাসা একেবারেই নি:স্বার্থ। খাঁটি। নিস্কলুষ।
আমার কাছে শুধু লেখাগুলো আছে। ম্যাগাজিনের কপি নেই। যে দুটো ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ দিলাম তাও পাঠিয়েছেন দুই মেয়ে বন্ধু। দুটোতেই আমার লেখা আছে।
২০০০ সালে ফোবানা সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে সম্পাদক শফিক রেহমান ও মিসেস তালেয়া রেহমান নিউইয়র্কে গিয়েছিলেন। আমি তখন নিউইয়র্ক ছেড়ে ফ্লোরিডা থাকতাম। লেখক হিসেবে আমার সঙ্গে সব সময় উনার যোগাযোগ ছিলো। আমি শফি ভাই ও তালেয়া ভাবীকে ফ্লোরিডা আমার কাছে বেড়াতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। দুজনই ফ্লোরিডা গিয়েছিলেন। আমরা অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি। ফ্লোরিডা আমার বাসায় রাতে তোলা একটা ছবিতে শফিক রেহমান ও মিসেস তালেয়া রেহমানের সঙ্গে আমি।
© Karim Chowdhury
28 October, 2023
Cumilla.মা
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন