সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

কেলোসাহাটশি-র তীরে

 কেলোসাহাটশি-র তীরে


----------------------------------

করিম চৌধুরী

আমেরিকার পঞ্চাশটি স্টেটের যেমন ভিন্ন ভিন্ন প্রতীক, ফুল, পাখি, পতাকা, সংবিধান, রাজধানী, জীবনযাপন, তেমনি আবহাওয়াও ভিন্ন। নিউ ইয়র্ক, মেরিল্যান্ড, অরেগন, ইন্ডিয়ানা, কেন্টাকি, কলোরাডো, ইলিনয়েস, ওয়াশিংটনে (ওয়াশিংটন ডিসি আমেরিকার রাজধানী। ওয়াশিংটন স্টেট ওয়েস্ট কোস্টে কানাডার ভ্যাংকুভারের সঙ্গে। যার রাজধানী অলিম্পিয়া) যখন প্রচুর তুষারপাত হয়, শীতে মানুষ জমে যায়, মাইনাস তাপমাত্রায় নাকের পানি ঝরে, কান লাল হয়ে যায় তখন কয়েক কেজি কাপড় পরতে হয়। যেমন স্যান্ডো গেঞ্জি। তার ওপর টেরিউলের গলাবন্ধ ফুল হাতা গেঞ্জি। তার ওপর জিন্স বা মোটা কাপড়ের শার্ট অথবা ভারী সোয়েটার। তার ওপর মাথা ঢাকা লেদার জ্যাকেট অথবা হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ওভারকোটসহ হাত মোজা বা গ্লাভস। গ্লাভস না পরলে মাইনাস তাপাত্রায় আঙুলের ডগায় ফ্রস্ট বাইট হতে পারে। ফ্রস্ট বাইট হলে আঙুলের ডগাগুলো চিরদিনের জন্য অসাড় হয়ে যায়।

ওই সব স্টেটে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যখন রক্ত ঠান্ডা করা শীত তখন ফ্লোরিডায় একটি টি-শার্ট এবং শর্টস পরে ঘুরে বেড়ানো যায়।

কয়েকদিন আগে ফেসবুকে আমাদের এক মেয়ে বন্ধু সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে লিখেছিলেন, আপনারা লক্ষ্য করবেন, মেয়েদের আপার পার্টের অনেক কিছুই B এবং লোয়ার পার্টের অনেক কিছু P দিয়ে। যেমন : আপারে, ব্লাউজ, ব্রা, বিকিনি এবং লোয়ারে পেটিকোট, প্যান্টি, প্যান্ট। আমি Bতে (ব্রেস্ট) এবং P দিয়ে (পুসি) করে আরো দুটো শব্দ যোগ করে চার জোড়া করে দিয়েছিলাম।

উইন্টারে ইওরোপ-আমেরিকায় পুরুষেরাও লোয়ার পার্টে অনেক কিছু পরে। শুধু প্যান্ট ও আন্ডারওয়্যারে চলে না। যা শীত! প্যান্টের নিচে ইনার মাস্ট পরতে হয়।

ফ্লোরিডা দক্ষিণ-পূর্ব আমেরিকার শেষ স্টেট। তিন দিকেই সমুদ্র। আটলান্টিক মহাসাগর এবং মেক্সিকো উপসাগর ঘিরে রেখেছে ফ্লোরিডাকে। অন্যদিকে জর্জিয়া এবং অ্যালাবামা স্টেট। মেক্সিকো উপসাগরের এ পাড়ে ফ্লোরিডা, ৯০ মাইল দূরে দ্বীপ রাষ্ট্র ফিডেল ক্যাস্ট্রো-র কিউবা। ক্যাস্ট্রো প্রায় প্রতিদিনই ক্লিনটন এবং বুশকে মূর্খ বলে গালাগাল দিতেন। এখন ওবামাকে গালাগাল করেন ক্যাস্ট্রোর ভাবশিষ্য ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হিউগো শাভেজ।

ফ্লোরিডার রাজধানী টালাহাসি। নিউ ইয়র্কের যেমন অ্যালবেনি। ফ্লোরিডায় সারা বছর টুরিস্ট থাকলেও অক্টোবর থেকে বেড়ে যায় এর সংখ্যা। হোটেল মোটেল সব হাউসফুল থাকে।

দক্ষিণ আমেরিকা তথা ল্যাটিন আমেরিকার বারোটি দেশ- ব্রাজিল, বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা, পেরু, ভেনিজুয়েলা, চিলি, কলম্বিয়া, গায়ানা, উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে, ইকুয়েডর, সুরিনাম ছাড়াও সেন্ট্রাল আমেরিকার কোস্টারিকা, হন্ডুরাস, গুয়াতেমালা, বেলিজ, নিকারাগুয়া, এল সালভাদর এবং পানামা থেকেও আসে প্রচুর টুরিস্ট। জাপান, মেক্সিকো, ইওরোপ, অস্ট্রেলিয়ার টুরিস্ট তো আছেই। এর ওপর আমেরিকার শীতপ্রধান স্টেটগুলো থেকে অসংখ্য টুরিস্ট ফ্লোরিডায় আসে।

দক্ষিণ আমেরিকায় ব্রাজিল সবচেয়ে বড় দেশ। ব্রাজিলের ভাষা পর্টুগিজ এবং বাকি এগারোটি দেশসহ সেন্ট্রাল আমেরিকার সব দেশের ভাষা স্প্যানিশ। ব্রাজিল পর্টুগালের কলোনি ছিল। বাকি সব দেশ ছিল স্পেনের কলোনি। ভারতবর্ষ যেমন ছিল বৃটেনের।

ধনী অনেক লোক শীত থেকে বাঁচতে তিন-চার মাস ফ্লোরিডায় কাটিয়ে যান। বাইরের ধনী ছাড়াও আমেরিকার ধনী লোকেরা ফ্লোরিডায় বাড়ি, কন্ডো, ফ্ল্যাট কিনে রেখেছেন। বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় তারা ফ্লোরিডায় থাকেন।

ফ্লোরিডার ডাক নাম সানশাইন স্টেট। এখানে কখনোই তুষারপাত হয় না। দ্বীপ আর সমুদ্র সৈকতে ভরপুর ফ্লোরিডা। আবহাওয়া ঠিক বাংলাদেশের মতো। প্রকৃতিও। বাংলাদেশে যেটুকু শীত আছে, ফ্লোরিডায় তাও নেই। সারা বছর বেশ গরম। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে একটু কম। ধনী দেশ বলে গরম গায়ে লাগে না। বাস, ট্রাক, ট্রেন, কার, অফিস, কোর্ট, পোস্ট অফিস, হোটেল, রেস্তরা, দোকান, বাড়ি, কর্মস্থল, টয়লেট সবই এয়ারকন্ডিশনড। জাম গাছে জাম, আম গাছে আম, নারিকেল গাছে ডাব। লিচু বাগান, কলা বাগান, কমলালেবুর বাগান, ইংরেজিতে যাকে বলে অরেঞ্জ গ্রোভ(Orange Groove) এসবই ফ্লোরিডায় আছে। এদিকে সেদিকে অনেক প্রাকৃতিক পুকুর। কিন্তু এতই পরিচ্ছন্ন আর সাজানো যে, দেখলে মনে হয় কৃত্রিম।

অনেক প্রজাতির মাছ আছে ওই সব পুকুরে। যে কেউ ধরতে পারে। পাশেই সমুদ্র। অনেক নদী, শাখা-উপনদী। ফিশিং করার অবারিত সুযোগ। এক ঘণ্টা ফিশিং করলে দুই সপ্তাহ মাগনা মাছ খাওয়া যায়। ফ্লোরিডায় যারা থাকে তাদের প্রায় সবারই বড়শি আছে। আমারও ছিলো। 

তাপস ভাই ও লতা ভাবী। তাদের দুই সন্তান প্রান্ত, অন্ত। বাবুল ভাই ও তসলিমা ভাবী। তাদের দুই সন্তান তামান্না, কাউসাইন। সোহেল-মিশা। তাদের দুই সন্তান অর্থী, অতুল। আমি আর সোহেল সমবয়সী। তুই-তোকারি সম্পর্ক। অন্য দু'জন একটু সিনিয়র। কখনো রোববারে পোর্টেবল চুলা, মশলা, লবণ, তেল, ছুরি, কাচি, ফোল্ডিং চেয়ার, বড়শি নিয়ে যেতাম সেনিবেল আইল্যান্ডে। ফোর্ট মায়ার্স সিটি থেকে লম্বা বৃজ আর সুদৃশ্য প্রসস্থ রাস্তা দিয়ে এই দ্বীপের সঙ্গে সংযোগ। আমাদের সেন্ট মার্টিন দ্বীপের অবস্থানের মতো। টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিন পর্যন্ত রাস্তা হলে যেমন দুই দিকে বঙ্গোপসাগর থাকবে, ঠিক তেমন। সঠিক পরিকল্পনা, দূরদৃষ্টি, নিরাপত্তা, যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে আমাদের কক্সবাজার হতে পারতো এশিয়ার ফ্লোরিডা।

ওই আইল্যান্ডে যাওয়ার রাস্তার পাশে গাড়ি পার্ক করে আমরা নেমে পড়তাম। ভাবিরা টাওয়েল বিছিয়ে আর চেয়ার বসিয়ে চুলা, ছুরি, মশলাপাতি নিয়ে বসতেন। তাপস ভাইয়ের লেক্সাস জিপ, বাবুল ভাইয়ের হোন্ডা ওডিসি মাইক্রো, সোহেলের নিসান আলটিমা আর আমার ছিলো হোন্ডা সিভিক সিডান। দুইদিকে মেক্সিকো উপসাগর। নয়নাভিরাম দৃশ্য। আমরা যার যার বড়শি নিয়ে মাছ ধরতাম। ভাবিরা সঙ্গে সঙ্গে মাছ কেটে সমুদ্রে ধুয়ে বারবিকিউ করে দিতেন। সবাই মজা করে খেতাম। কারো বড়শিতে মাছ না লাগলে বাকি ছয়জনের ইয়ার্কিতে তার জীবন অতিষ্ট হয়ে যেতো। স্যালমন ফিশ, ক্যাট ফিশ, সারদিন ফিশ, রেড ফিশ, বড় সাইজের তেলাপিয়া এবং চাপিলাও পাওয়া যেতো। আমাকে কেউ ইয়ার্কি করলে বলতাম, আপনাদের বৌ, বাচ্চা, স্বামী আছে। আমি ব্যাচেলর। তাই সৃষ্টিকর্তা আপনাদের আগে দিয়েছেন। নয়তো বৌ-বাচ্চারা কান্নাকাটি করবে। আমি মাছ না পেলেও আপনাদের বারোজনের সঙ্গে খেয়ে ফেলতে পারবো।

তাপস ভাই বলতেন, তুই তাড়াতাড়ি বিয়ে কর। আজান দিয়া আর কতো দিন চলবি? ভাবীরা যে তোর দিকে আড় চোখে তাঁকায় তাতো দেখতেই পাচ্ছি।

সোহেলের স্ত্রী মিশা আমাকে আর সোহেলকে কড়া পাহারায় রাখতো। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো, আমরা একটু চান্স পেলেই বিয়ার খেয়ে ফেলবো। তাই নজরদারি ছিলো এফবিআইয়ের মতো। যদিও আমরা গাড়িতে বিয়ার নিয়ে সীটের নিচে লুকিয়ে রেখেছি। বিয়ার খেয়ে মাছ ধরা খুব মজা।

ফ্লোরিডায় বেশির ভাগ লোকের স্পিড বোট আছে। বেশি স্বচ্ছলদের আছে ইয়ট বা প্রমোদতরী। অনেকের আছে ব্যক্তিগত ছোট প্লেন। কোস্টাল স্টেট বলে ফ্লোরিডায় প্রচুর ঝড়বৃষ্টি ও জলোচ্ছ্বাস হয়।

ফ্লোরিডা আয়তনে বাংলাদেশের চেয়ে বড়। বর্তমান লোকসংখ্যা মাত্র এক কোটি নব্বই লাখ। অদক্ষ, অনভিজ্ঞদের ন্যূনতম বেতন ঘণ্টায় সাড়ে সাত ডলার। এটি সরকার নির্ধারিত। কোনো মালিক কম বেতন দিলে কঠিন শাস্তি।

কিছু প্রধান কারণে ফ্লোরিডা অনেকেই দেখতে চায়। কি ওয়েস্ট (Key West) দ্বীপে নোবেল লরিয়েট আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বাড়ি। বিদ্যুৎ বাতি আবিষ্কারক টমাস আলভা এডিসনের বাড়ি ফোর্ট মায়ার্স-এ। অরল্যান্ডোতে নাসা বা কেনেডি স্পেস সেন্টার। মানুষ এখান থেকেই মহাশূন্যে যায় । চলচ্চিত্রের জন্য বিখ্যাত ইউনিভার্সাল স্টুডিও, তাও অরল্যান্ডোতে। আছে ডিজনি ওয়ার্ল্ড এবং এপকট (Apcot ) সেন্টার বা শিক্ষামূলক পার্ক।। মায়ামি বিচের কথা বলাই বাহুল্য।

নিউ ইয়র্কে কয়েক বছর থেকে বেড়াতে গেলাম ফ্লোরিডায়। পরিচিত বন্ধুরা আমাকে ধরে রেখে দিলো।

মেক্সিকো উপসাগরে ঘেরা মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপূর কম জনসংখ্যার একটি শহর ফোর্ট মায়ার্স। সাগরের পেটের ভেতরে এই শহর। একেবারে কান্ট্রি  সাইড। গ্রাম গ্রাম ভাব। মানুষ কম। শান্ত, নিরিবিলি।

নিউ ইয়র্ক, লস এঞ্জেলেস, লাস ভেগাস, সান ফ্রান্সিসকো, বস্টন, শিকাগোর মতো ক্রাউডেড, ব্যস্ত আর প্রাণচঞ্চল শহর নয় ফোর্ট মায়ার্স। আমেরিকা ফেডারেল গভর্নমেন্টের দেশ বলে প্রতিটি স্টেট নিজস্ব স্বকীয়তা ভোগ করে।

ফ্লোরিডিয়ান লাইফে রাত একটা-দুইটাতেও আমি গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। বিকেলের শিফটে কাজ করতাম বলে রাতে ঘুমানোর তাড়া ছিল না। সী বিচে এবং নদীর পাড়ে সারা রাতই মানুষ থাকে। বেশির ভাগ দোকান, গ্যাস স্টেশন এমনকি ওয়ালমার্ট-এর মতো চেইন স্টোরও সারা রাত খোলা থাকে। টুরিস্টদের জন্য আছে সব রকম বিনোদন ব্যবস্থা।

এক রাতের কথা। আমি ইউএস ৪১ হাইওয়ে ধরে গাড়ি চালাচ্ছিলাম। ফোর্ট মায়ার্স সিটির বুক চিড়ে চলে গেছে কেলোসাহাটশি (Calossahatchi) নদী। এই নদীর ওপর বৃজের শেষ মাথায় নদীর পানি ঘেষে লম্বা কিছু কাঠের টেবিল। টেবিলের উভয় দিকে বেঞ্চ। যাতে কয়েকজন মুখোমুখি বসতে পারে। নদীর পাড় ঘেষে হাইওয়ে। রিভারসাইড ড্রাইভ। বৃজের শেষে উভয় পাশে পার্কিং। কারো ইচ্ছা হলে গাড়ি থামিয়ে বসতে পারে। সময় কাটাতে পারে। এই জায়গায় আমি মাঝে মাঝে রাতে একাকী কিছুক্ষণ বসতাম।

ওই রাতে গাড়িটা পার্ক করে একটা বেঞ্চে বসে ছিলাম। উইক ডে ছিল বলে বেশি মানুষ ছিলো না। অন্য একটিতে এক ভদ্রলোক টেবিলের ওপর বসে বেঞ্চে পা রেখে হাঁটুর ওপর কনুই ঠেসে দুই গালে হাত দিয়ে এক দৃষ্টিতে নদীর দিকে তাঁকিয়ে ছিলেন। তার টেবিলের ওপরে কয়েকটি বাডওয়াইজার বিয়ার। পাশে কালো রঙের করভেট (Corvette) কনভার্টিবল কার। করভেট আমেরিকার দামি গাড়ি। বা দিকের দরজা খোলা। আমেরিকায় লেফট হ্যান্ড ড্রাইভ। গাড়িতে হুইটনি হিউসটন-এর খুব জনপ্রিয় প্রেমের গান

'আই উইল অলওয়েজ লাভ ইউ' বা আমি চিরকালই তোমাকে ভালোবাসবো বাজছিলো। হুইটনি হিউসটন এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে মাত্র উনপঞ্চাশ বছর বয়সে মারা গেছেন।

এ জায়গাটির আলাদা সৌন্দর্য ছিল। সামান্য দূরে দৃষ্টিসীমার মধ্যে কেলোসাহাটশি নদীটি মিশে গেছে মেক্সিকো উপসাগরে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উপসাগর মেক্সিকো উপসাগর বা গালফ অফ মেক্সিকো।

আমি ভদ্রলোককে ফলো করছিলাম। রাত হলেও আলোয় ঝলমল করছিলো চারদিক। আমেরিকা বলে কথা।

হঠাৎ দুজনের চোখাচোখি হতেই তিনি ভ্রু নাচিয়ে 'হাই' বলে সৌজন্য বিনিময় করলেন। এটা আমেরিকান কালচার। কেউ কাউকে না জানলেও চোখাচোখি হলে একজন আরেকজনকে 'হাই' বলে সৌজন্যতা দেখায়। যার অর্থ 'এই যে'। আমিও হাই বলে প্রতি সৌজন্য দেখালাম।

কিছুক্ষণ পর ভদ্রলোক যেচে আমাকে বললেন, হাই ম্যান, ফিলিং লোনলি? আপসেট? কাম অন। লেটস টক।

আমি উঠে গিয়ে 'হাই নাইস মিটিং ইউ' বলে হ্যান্ডশেক করে তার মতোই টেবিলের ওপর বসে বেঞ্চে পা রাখলাম। প্রথমে তিনি আমাকে স্প্যানিশ ভাষায় জিজ্ঞেস করলেন সিনর, গোমস্তা? অর্থাৎ মিস্টার, কেমন আছো?

আমি কিছুটা থতমত খেয়ে গেলাম। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, মুই বিয়েন। অর্থাৎ খুব ভালো আছি।

স্প্যানিশ ভাষায় সিনর মানে মিস্টার। চলার মতো স্প্যানিশ ভাষা আমার জানা আছে। আমেরিকায় কম-বেশি সবাই স্প্যানিশ ভাষা জানে।

বলা প্রয়োজন, ইংরেজির পর আমেরিকায় স্প্যানিশ ভাষাভাষীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এক বর্ণ ইংরেজি না জেনেও স্প্যানিশ ভাষা লিখতে, পড়তে, বুঝতে এবং বলতে পারলে আমেরিকায় স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করা যায়। স্প্যানিশ ভাষা আমেরিকায় সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত।

সৌজন্য বিনিময়ের পর তিনি আমাকে বিয়ার অফার করলেন।

দু'জন একা মানুষ সহজেই ঘনিষ্ঠ হয়ে যেতে পারে। তাই হলো। কথাবার্তায় তার সম্পর্কে জানলাম। নাম ফ্রানসিসকো। আমেরিকার প্রতিবেশী মেক্সিকোর সিটিজেন। ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। আমেরিকায় তার ফ্যামিলির ইমিগ্রেশন আছে। বাবা কলোরাডোতে বিজনেস করেন। নিজে ব্যাচেলর। ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করেছেন। ইয়েল খুব নামকরা ইউনিভার্সিটি। 

আমি আমার দেশ এবং নিজের সম্পর্কে তাকে বললাম। হঠাৎ একটা বড় ঢেউ এসে ছিটকা পানিতে আমাদের ভালো লাগার মতো সামান্য ভিজিয়ে দিল। ভদ্রলোক তখন কবির মতো বললেন, নদীর পানি যায় সাগরের দিকে আর মানুষের জীবন যায় মৃত্যুর দিকে।

তার এ মন্তব্যে তার সম্পর্কে জানার কৌতূহল জাগলো।

মানসিক মিল থাকলে কখনো কখনো অল্প সময়ের পরিচয়ে খুব ঘনিষ্ঠ হওয়া যায়। তার অনুমতি নিয়েই কিছু ব্যক্তিগত কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি গম্ভীর হয়ে গেলেন। তাকে প্রশ্ন করার জন্য অ্যাপোলজি চাইলে ইটস ওকে বলে উড়িয়ে দিলেন। তারপর একটা বিয়ারের ক্যান খুলে বিরতি না দিয়েই ঢক ঢক করে পুরো বিয়ারটা খেয়ে ক্যানটা তাচ্ছিল্য ভরে নদীতে ছুড়ে একটা সিগারেট ধরালেন। তার সিগারেটের ব্র্যান্ড দামি এবং ভালো। রোস্টেড টোবাকোর চেস্টারফিল্ড (Cestarfield) সিগারেট খান তিনি।

সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে একগাল ধোয়া ছেড়ে বললেন, ক্যারিম, ডু ইউ লাইক স্টোরি? ডু ইউ?

বললাম, ইয়েস, আই ডু।

ফ্রানসিসকো বললেন, অলরাইট এক পৃন্সের গল্প শোনো।

এক রাজপুত্র ভালোবাসে প্রতিবেশী রাজ্যের এক রাজকন্যাকে। কিন্তু দুই রাজ্যের রাজার মধ্যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক। যুদ্ধংদেহী মনোভাব। এই বিয়েতে কোনো রাজাই রাজি নন। দীর্ঘদিন অপেক্ষার পর রাজপুত্র সিদ্ধান্ত নিলেন, যেকোন মূল্যেই রাজকন্যাকে তার চাই।

এক ভোরে রাজপুত্র সোনা, গয়না, হীরা, মণি-মাণিক্য নিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে যাত্রা করলেন রাজকন্যার কাছে। অনেক দূর যাওয়ার পর রাজপুত্রের সামনে পড়লো এক নদী। আশপাশে বাড়িঘর, লোকজন কেউ নেই। নির্জন, নিস্তব্ধ এলাকা। অনেক খুঁজে রাজপুত্র পেলেন এক মাঝি। একটি মাত্র নৌকা, একজন মাত্র মাঝি। রাজপুত্র মাঝিকে অনুরোধ করলেন, মাঝি, আমাকে তুমি নদী পার করে দাও। বিনিময়ে তুমি যা চাইবে আমি তাই দেবো।

মাঝি বললো, এক শর্তে তোমাকে নদী পার করে দিতে পারি।

রাজপুত্র উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, বলো মাঝি, তোমার কি চাই?

মাঝি বললো, তুমি যদি তোমার হৃদয়ের অর্ধেক আমাকে দাও তবে আমি তোমাকে নদী পার হতে সাহায্য করবো।

রাজপুত্র বিচলিত হয়ে দুই পা পেছনে গিয়ে বিব্রতভাবে বললো, না, কিছুতেই না। এ হৃদয় তো শুধুই আমার রাজকন্যার জন্য। কিভাবে তা তোমাকে দিই?

কিন্তু মাঝি তার সিদ্ধান্তে অটল রইলো।

রাজপুত্র অনেক ভেবে নিরুপায় হয়ে অসহায়ের মতো মাঝির প্রস্তাবে রাজি হলেন।

ঠিক করলেন বাকি অর্ধেক হৃদয়ই দেবেন তার রাজকন্যাকে।

নদী পার হয়ে অর্ধেক হৃদয় নিয়ে রাজপুত্র উদভ্রান্তের মতো ঘোড়া ছুটিয়ে চললেন রাজকন্যার কাছে। প্রিয়জনকে কাছে পাওয়ার উদগ্র বাসনা মনে। অর্ধেক হৃদয় হারিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তবু দমে যাননি রাজপুত্র।

সূর্যাস্তের পূর্বেই রাজপুত্র পৌছে গেলেন দুই রাজ্যের সীমান্ত এলাকায়। সেখানে দুই রাজ্যকে বিভক্ত করেছে একটি প্রমত্তা নদী। নদীর পাড়ে এসে রাজপুত্র দেখলেন ওই পাড়ে নদীর পাড় ঘেষে যে পাহাড়, তার ওপর সেজেগুজে রাজপুত্রকে কাছে পাবার প্রবল বাসনা নিয়ে অধীর আগ্রহে বসে আছেন রাজকন্যা।

এখানেও একটি মাত্র নৌকা এবং একজন মাঝি। অনেক দূরে সীমান্ত প্রহরীদের সশস্ত্র পদচারণা। রাজপুত্র মাঝিকে আকুলভাবে অনুরোধ করলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নদী পার করে দিতে। বিনিময়ে মাঝি যা চাইবে তাই দিতে প্রস্তুত রাজপুত্র।

মাঝি রাজপুত্রকে বললো, তুমি তোমার হৃদয়ের অর্ধেক আমাকে দেবে। এটুকুই আমার ভাড়া।

রাজপুত্র বিব্রত, বিচলিত, দুঃখিত, চিন্তিত, বিপর্যস্ত। মাঝিকে অনুরোধ করে বললেন, সোনা, গয়না, হীরা এমনকি ঘোড়াটিও তোমাকে দেবো নদী পার করার বিনিময়ে।

কিন্তু মাঝি শুধু হৃদয়ের অর্ধেক পেলেই রাজপুত্রকে খেয়া পারে রাজি ।

রাজপুত্র হতাশ। পরে ভাবলেন, ফিরে গিয়ে অতিক্রান্ত নদী পুনরায় পার হতে মাঝিকে হৃদয়ের বাকি অর্ধেক দিয়ে নিঃস্ব হওয়ার চেয়ে এগিয়ে যাওয়া ভালো।

রাজপুত্র ডেসপারেট হলেন। পেছনে ফিরে হারানোর চেয়ে সামনে এগিয়ে রাজকন্যার সান্নিধ্য পাওয়া অনেক কাংখিত । রাজপুত্র মাঝির শর্তে রাজি হলেন।

নদী পার হয়ে রাজপুত্র নৌকা থেকে নামলেন। হৃদয়ের বাকি অর্ধেকটা মাঝিকে দান করলেন।

তাঁকিয়ে দেখলেন তার স্বপ্নের রাজকন্যা উঠে দাঁড়িয়ে দুই হাত বাড়িয়েছেন রাজপুত্রকে বুকে টেনে আলিঙ্গন করার জন্য।

রাজপুত্র চোখ ফিরিয়ে নিলেন। মুহূর্তেই তিনি হয়ে গেলেন অন্য মানুষ। রাজকন্যাকে দেবার কিছুই যে তার নেই। হৃদয়হীন মানুষের একজন তিনি। কি দেবেন তাকে? কেন যাবেন তিনি রাজকন্যার কাছে?

পাহাড়ের পাড় ঘেষে নিঃস্ব রাজপুত্র উদাসীনভাবে হাঁটতে লাগলেন অজানার উদ্দেশে। রাজকন্যা পড়ে রইলেন পেছনে।

ফ্রানসিসকো আমাকে প্রশ্ন করলেন, হাউ ডু ইউ ফিল ক্যারিম? ডু ইউ লাইক দি স্টোরি?

আমি চুপ করে থাকলাম। বুঝলাম কোনো এক নারী তার হৃদয় ভেঙে দিয়েছে। আমার সঙ্গে এই গল্পের অনেক মিল। ফ্রান্সিসকোও আমার মতো!!!

ফ্রানসিসকো আরেকটা বিয়ার খেয়ে ক্যানটা পা দিয়ে পিষে বালির নিচে ঢুকিয়ে দিলেন। নদী থেকে দুই হাতে এক আজলা পানি তুলে মুখ ধুয়ে আমাকে, ইউ টেক কেয়ার ক্যারিম, থ্যাংকস ফর ইওর টাইম, ইউ আর এ গুড লিসেনার, হ্যাভ এ নাইস নাইট। 

বলে তার করভেট গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে হাই ভলিউমে ব্রায়ান অ্যাডামসের সাড়া জাগানো প্রেমের গান অন করলেন, এভরিথিং আই ডু বা আমি যা করি তার সবই।

রিয়ার গিয়ারে গাড়িটা রাফলি ব্যাক করে ইউএস ৪১-এ উঠে খুব দ্রুতগতিতে ফ্রানসিসকো চলে যাচ্ছিলেন।

আমি ঘাড় বাঁকিয়ে বিষণ্ণ মনে গাড়িটার দিকে তাঁকিয়ে রইলাম।

© Karim Chowdhury 

মৌচাকে ঢিল

আগস্ট ২০১৩

রেইসকোর্স, কুমিল্লা থেকে

karimcbd@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আমার দেখা ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ

আমার দেখা ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ সরকারঃ শেখ মুজিবের শাসনামল ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের মার্চে শুরু হয়ে সেই বছরেরই ডিসেম্বরের দিকে গিয়ে শেষ হয়। এই দুর্ভিক্ষে অসংখ্য মানুষ অনাহারে মারা গিয়েছিল। এই দুর্ভিক্ষকে স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক হিসেবে গন্য করা হয়। ওই সময় আমি বুঝতাম। ক্লাশ ফোরে পড়তাম। আহারে ! কি যে অভাব ! অনেকের মতো আমরাও ভাত না খেয়ে রুটি খেয়েছি । তাও পরিমিত । কখনো জাউ খেয়েছি । শুকনো মরিচ পাওয়া যেতো না । কাঁচা মরিচের কেজি ছিলো ১৫০ টাকা । লবন ১২০ টাকা । আর সোনার ভরি ছিলো তখন ১৫০ টাকা । সোনা শুধু ওই সময় কম দাম ছিলো । চারদিকে অভাব । সারাদেশের মানুষের হাহাকার । কতো মানুষ না খেয়ে মারা গেছেন ! বিদেশি রিলিফ সব আওয়ামী লীগের লোকেরা চুরি করেছে । আর বেশিরভাগ রিলিফ সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে পাচার হয়েছিলো । তখন বর্ডার খোলা ছিলো তখন । মহিলাদের শাড়ি কাপড় ছিলো না । অনেকে মাছ ধরার জাল পরে লজ্জাস্থান ঢেকেছিলো । এসব ছবি পত্রিকায়ও ছাপা হয়েছিলো । কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতাদের কোনো অভাব ছিলো না । বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র দুই বছর তিন মাসের মাথায় ...

বোতল

বোতল মানব জীবনে বোতল অপরিহার্য । বোতল অনেক অর্থেও ব্যবহার হয় । কোনো কোনো এলাকায় আনস্মার্ট, বেয়াক্কেল প্রকৃতির লোককেও বোতল বলা হয় । ইউরোপ আমেরিকায় থাকতে আমি ডৃংক করতাম । হার্ড ডৃংক কমই খেতাম । প্রতিদিনই বিয়ার খেতাম । বিয়ার স্বাস্থ্য ভালো রাখে ও কাজ করতে এনার্জি জোগায় । পরিমিত বিয়ার খেলে কেউ মাতাল হয় না । মাঝে মাঝে বিশেষ কোনো পার্টিতে হুইস্কি খাওয়া হতো । তাও দামি ব্র্যান্ডের । জনি ওয়াকার ব্ল্যাক লেবেল, টিচার্স, পাসপোর্ট, হেনেসি, শিভাস রিগাল, জ্যাক ড্যানিয়েলস । সাকুরায়ও অনেক সময় এসব ব্র্যান্ডের হুইস্কি পাওয়া যায় না । তো দেশে আসার পরও কিছু দিন ডৃংক করেছিলাম । কুমিল্লায় সরকার অনুমোদিত একটা মদের দোকান আছে চক বাজারে । নামঃ নাদের ট্রেডিং কোং । এটা প্রায় আজ ৫০ বছর । এখানে বিদেশি ব্র্যান্ডের ডৃংক পাওয়া যায় না । দেশিয় কোম্পানি ‘কেরো এন্ড কোং’ যা দর্শনায় অবস্থিত তার তৈরি ভদকা, হুইস্কি, জিন পাওয়া যায় । আমাদের সমাজতো রক্ষনশীল । তাই কান্দিরপাড় থেকে একটা স্প্রাইট কিনে অর্ধেক খেতে খেতে চক বাজার যেতাম । নাদেরে যখন পৌঁছতাম তখন স্প্রাইটের বোতল অর্ধেক খালি হয়ে যেতো । আমি বাবুল ভাইকে স্প্...

অশ্লীল নাম

বাংলাদেশের কিছু প্রতিষ্ঠান ও স্থানের বিচিত্র বা বিকৃত অর্থের নাম যা পরিবর্তন করা উচিতঃ ১. বোদা মহিলা মহাবিদ্যালয়, বোদা, পঞ্চগড় ২. চুমাচুমি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রাঙ্গামাটি ৩. সোনাপোতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, খুলনা ৪. মানুষমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নীলফামারি ৫. সোনাকাটা ইউনিয়ন, তালতলী, বরগুনা ৬.বড়বাল ইউনিয়ন, মিঠাপুকুর, রংপুর ৭.সোনাখাড়া ইউনিয়ন, রায়গঞ্জ, সিরাজগঞ্জ ৮. ধনকামড়া গ্রাম, ভোদামারা, দিনাজপুর ৯.গোয়াকাটা, দোহার, ঢাকা ১০. গোয়াতলা, ময়মনসিংহ ১১.লেংটার হাট, মতলব, চাঁদপুর