সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ওমাওয়ারিসান

 ওমাওয়ারিসান 

----------------------

করিম চৌধুরী

টোকিওর ব্যস্ত এলাকা শিনজুকুতে আমাদের স্কুল। নামমাত্র ল্যাংগুয়েজ স্কুলে যাই। নামমাত্র বললাম এই জন্য যে, টোকিওর মাটিতে পা রেখেই শুধু ভাষার কারনে দেশটি আমার অপ্রিয় হয়ে গেলো। যদিও জাপানি খুব শ্রুতি মধুর একটা ভাষা। আমরা কয়েক বন্ধু এই স্কুলটিতে ভর্তি হয়ে ঢাকার জাপানি দূতাবাস থেকে ভিসা নিয়ে পড়াশোনার উদ্দেশেই টোকিও গিয়েছিলাম। আমাদের ভিসা স্ট্যাটাস ছিলো ৪-১-১৬-৩ । ছয় মাস পর পর ভিসার মেয়াদ বাড়াতে হয়। আমাদের ল্যাংগুয়েজ স্কুলটির নাম ছিলো ‘জাপান ফরেন ল্যাংগুয়েজ ইন্সটিটিউট ইনকর্পোরেটেড’ (Japan Foreign  Language  Institute Incorporated) সংক্ষেপে বলা হতো জাফলি JAFLI.

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রচুর ছাত্রছাত্রী এই স্কুলে। বিশেষ করে অনুন্নত দেশগুলোর। চীন, ফিলিপিন্স, মঙ্গোলিয়া, ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া,  ইন্ডিয়া, উত্তর কোরিয়া, পাকিস্তানসহ আরো অনেক দেশের। কিন্তু জানুয়ারি মাসের প্রচন্ড শীতে টোকিওর নারিতা এয়ারপোর্টে নেমে 'স্কাই লাইনার' এক্সপ্রেস ট্রেন ধরে টোকিও মূল শহরে পৌঁছে প্রায় পাগল হয়ে গেলাম। কিচ্ছু পড়তে পারিনা। দোকানের সাইনবোর্ড থেকে সাবওয়ে ডাইরেকশন পর্যন্ত জাপানিতে লেখা। কোনো ইংরিজি শব্দ চোখে পড়লো না। এসএসসি-এইচএসসি দু’টোতেই ফার্স্ট ডিভিশন। ভেবেছিলাম পড়াশোনা করবো। কিন্তু ভাষা দেখে প্রথম দিনেই আমার হৃদয় ভেঙে পানির মতো তরল হয়ে গেলো। ঢালু পেলেই তরল গড়ায়। সেই থেকে আমিও গড়ানোর ধর্ম পালন করে চললাম। বিদেশে পড়ার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেলো। সূর্যোদয়ের দেশ আমার কাছে সূর্যাস্তের দেশ হয়ে গেলো। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে গেলো। ভাগ্যিস পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিইনি। 

'উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশ যাত্রা।'

জাফলির অর্থাৎ আমাদের স্কুলের মালিক কাম প্রেসিডেন্ট কাম চিফ এক্সিকিউটিভ কাম বিজনেসম্যান ছিলেন একজন আমেরিকান। ভদ্রলোকের নাম ছিলো মারভিন এল টুইলজার। একদিন স্কুলে গিয়ে দেখি ক্লাশে নয় জন ছাত্র। একজনও বাংলাদেশি নেই। হরতনের গোলামের মতো গোঁফওয়ালা দুইজন পাকিস্তানি, তিনজন ভিয়েতনামি, দুইজন ফিলিপিনো,দুইজন উত্তর কোরিয়ার ছাত্র। প্রত্যেকের বয়স ৩০/৩৫। ওদের কাছে আমি নিতান্তই শিশু।

সে সময় জাপান সরকার জাপানি ভাষাকে জাপানের বাইরে জনপ্রিয় করার জন্য এ ধরনের ভাষা শিক্ষা স্কুলগুলোকে উৎসাহ দিতো। মাস খানেকের মধ্যে টোকিওতে ব্যাঙের ছাতার মতো ভাষা শিক্ষা স্কুল গজিয়ে উঠলো। প্রয়োজনীয় কিছু জরুরি ভাষা শিখে দেখলাম আমি তোতলা হয়ে যাচ্ছি।

আমিকে-ওয়াতাশি, তুমিকে-আনাতা, জাপানকে- নিহন বা নিপ্পন, কঠিনকে(Difficult) মুজোকাশি, বুঝেছোকে (Understand)-ওয়াকারিমাস্তা, এক্সকিউজ মি কে ছুমিমাছেন, জাপানি ভাষাকে-নিহঙ্গ, ভাতকে-গোহান, মাছকে-সাকানা, আলুকে-জাগাইমু, পানিকে-মিজু, কফিকে কহি, ট্রেনকে দেইংসা, মেয়েকে-ওন্না, পুরুষকে- ওতোকো, বন্ধুকে-তোমোদাছি, মানুষকে-জিন, বাংলাদেশকে-বাংগুড়াদেশ, টাকাকে-ওকানে, স্বাগতমকে- ইরাশ্যাইমাছে, ছাত্রকে-গাকছেই, স্কুলকে-গাক্কু, সু প্রভাতকে-ওহাইয়ো গুজাইমাছ, ধন্যবাদকে-দমো, সাবওয়েকে-চিকাতেৎসু, বিদায়কে-সাইওনারা, চাচাকে-অজিসান- মিথ্যাকে- উছো, সত্যকে-হন্ত, অলরাইটকে(Alright)-দাইজুবু, বিপদকে-আবুনাই, কি(What)কে-নানি, বিদেশিকে-গাইজিন, ভালোকে-ইয়ো, খারাপকে-দামে, দেশকে-কুনি, কাজকে-শিগোতো, চাওয়াকে(Want)-ঈশটাই, বরখাস্তকে-খুবি, মাকে-মামাসান, আর পুলিশকে ওমাওয়ারিসান শিখেই আমার অবস্থা কাহিল। 

ইতিমধ্যে জাপানের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক জাপান টাইমস ও আশাহি শিমবুন কয়েকদিন পড়লাম। কিন্তু দাম বেশি। এরপর ধরলাম একটু কম দাম কিন্তু ভালো পত্রিকা মাইনিচি ডেইলি নিউজ।

কিছুদিন পর আরেক গ্রেড নিচে নেমে এক বছরের জন্য গ্রাহক হলাম ইউমিউরি শিমবুন দৈনিকের। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ঘরেই পেপার পাই। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানতে পারি, টোকিওতে ভাষা শিক্ষার স্কুলগুলো পড়াশোনার নামে আদম ব্যবসা করছে। গরীব দেশের ছাত্রছাত্রীরাই এসব স্কুলে ভর্তি হয়ে জাপানে আসে এবং স্কুল না করে শুধু চাকরি করে। স্কুলের টিউশন ফি দিয়ে দিলেই স্কুল অথরিটি ছাত্র ছাত্রীদের "ভাষা শিক্ষা বিষয়ে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে" বলে সীল করা খামে কাগজপত্র দিয়ে দেন যা দেখে ইমিগ্রেশন অফিসার ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধি করেন। 

ছাত্ররা স্কুলের কাগজপত্রসহ পাসপোর্ট নিয়ে ওতেমাচি নামের টোকিওর সুন্দর অথচ ভীতিকর জায়গা ইমিগ্রেশন হেড কোয়ার্টারে যায় দুরু দুরু বুকে। আমিও গিয়েছিলাম। ইমিগ্রেশন অফিসার স্কুলের কাগজপত্র দেখেই ভিসা বাড়িয়ে দেন। পত্রপত্রিকায় এসব খবর প্রকাশিত হওয়ার পর নিজেকে আর ছাত্র বলে পরিচয় দিই না। ইতিমধ্যে আমরা ডাউন টাউন টোকিওর আকাবেনি, ইতাবাসি এবং ইকেবুকুরু এলাকার প্রতিবেশিসহ বেশিরভাগ জাপানির কাছে "উছো গাকছেই" অর্থাৎ মিথ্যা ছাত্র হিসাবে পরিচিত হয়ে গেলাম। উছো মানে মিথ্যা, গাকছেই মানে ছাত্র। এই কলঙ্ক ঢাকার আর কোন রাস্তা খোলা নেই।

চার মাস চলে গেছে অলরেডি। প্রচুর বাংলাদেশির সমাগম ঘটেছে টোকিওতে। এক শ্রেণির বাংলাদেশি মোটা টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশ থেকে অনেককে ভাষা শিক্ষা স্কুলে ভর্তি করিয়ে টোকিওতে নিয়ে গেলেন। আমরা পড়াশোনা করা সৎ ছাত্ররা মিথ্যা ছাত্র হয়ে গেলাম। চার মাসে তিনটি চাকরি করেছি। একটি দশ দিন, একটি তের দিন আরেকটি একদিন। দুটো ছেড়েছি আরেকটি থেকে হয়েছি 'খুবি' বা বিতারিত। 'খুবি' জাপানি শব্দ যার অর্থ চাকরি থেকে বরখাস্ত করা। তিনটিই হোটেলে প্লেট ধোয়ার কাজ। এই কাজকে জাপানি ভাষায় বলে 'আড়াইমনো'। ঝিম ধরে বাসায় বসে থাকি,বিয়ার খাওয়া শিখেছি একটু।

রেইসকোর্সের কাউসার আর আমি আলোচনা করলাম। কিভাবে পড়াশোনা করা যায়? চার বছর জাপানি ভাষা শিখে লেখাপড়া করা সম্ভব নয়। তাই আমরা দুই বন্ধু মিলে ইংরেজিতে পড়া যায় কিনা তা নিয়ে গবেষণা শুরু করলাম। প্রথমে গেলাম 'জসি সফিয়া ইউনিভারসিটিতে’। না। আন্ডার গ্র্যাজুয়েট কোর্স করতে হলে জাপানি ভাষায় করতে হবে। গেলাম 'কেও ইউনিভারসিটিতে' তাও হলো না। গেলাম ‘ওয়াসেদা ইউনিভার্সিটিতে’। নাহ। একই নিয়ম। সবশেষে গেলাম এশিয়ার শিক্ষা জগতের নক্ষত্র বলে পরিচিত টোকিও ইউনিভার্সিটিতে। এখানে ইংরেজিতে পড়ার সুযোগ আছে। টোকিও ইউনিভার্সিটির আন্ডার গ্র্যাজুয়েট কোর্স এর মাসিক টিউশন ফি ৯০০ ডলার। বাহ! ভালো তো! ভালো না? ১৯৮৬ সালে ৯০০ ডলার অনেক টাকা।

পার্ট টাইম কাজ করে বাড়ি ভাড়া, খাওয়া, যাতায়ত আর টিউশন ফি অসম্ভব। শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিলাম দেশে ফিরে যাবো। কিন্তু দেশে ফেরার বিমান ভাড়া নেই। এদিকে ভিসার মেয়াদ শেষ হবে জুন মাসে। ভিসা এক্সটেনশন করতে হলে এ মাসেই স্কুলের ছয় মাসের টিউশন ফি দিতে হবে ১২০০ ডলার। বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করে সেই টাকা স্কুলে দিলাম। ভিসাও এক্সটেনশন করলাম। ঠোঁটে কামড় দিয়ে কিছুদিন চাকরি করে বিমান ভাড়াটা হলেই দেশে চলে যাবো এই আশায়। আর ভাবলাম, এই সুযোগে একটা জাপানি মেয়ের সঙ্গে প্রেম করেই যাই। ওই সময় জাপানি মেয়েরা আমাদের খুব পছন্দ করতো। অনেকেই জাপানে বিয়ে করে সেটেল্ড হয়ে গেছে। প্রেম করতে তো ভাষা লাগবে। কিছু ভালোবাসার কথা শেখার চেষ্টা করলাম। প্রথমেই আই লাভ ইউ-র জাপানি শিখে আমি আবার তোতলানো শুরু করলাম। I love you কে জাপানি ভাষায় বলে 'ওয়াতাসি ওয়া আইস্তেরু'। এটা শিখে মনে মনে বললাম, ধুর, এই প্রেমট্রেমও জাপানি ভাষায় আমার দ্বারা হবে না।

ভিসা বাড়ানোর পরদিন দেখি ইউমিউরি শিমবুন( Yumuri Shimbun) পত্রিকায় পাঁচ কলাম জুড়ে হেড লাইন নিউজ...

Immigration Officials Raided language Schools. 

দীর্ঘ এই রিপোর্টের সারমর্মঃ  ইমিগ্রেশন অফিশিয়ালরা কয়েকটি স্কুলে হঠাৎ অভিযান চালিয়ে দেখেছে স্কুলের ছাত্র সংখ্যা যেখানে ৭০০ সেখানে ক্লাশে উপস্থিত আছে মাত্র ৬ জন। টোকিও পুলিশ হোটেল রেস্টুরেন্টসহ কিছু ফ্যাক্টরিতে অভিযান চালিয়ে অনেক উছো গাকছেই বা মিথ্যা ছাত্রকে ধরেছে। এখন থেকে ইমিগ্রেশন অফিসিয়াল স্কুলের কাগজপত্রের সঙ্গে ভিসা প্রার্থীর ভাষা জ্ঞানও পরীক্ষা করে ভিসা দেবে।

পত্রিকায় প্রকাশিত এসব খবর আমি নিজে পড়লাম। হৃদয় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। কি করতে এলাম। আর কি দেখছি! আমরা মিথ্যা ছাত্রদের কাছে "ওমাওয়ারিসান" বা পুলিশ এখন এক বিরাট আতংক। ইতিমধ্যে আমাদের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে কর্মক্ষেত্রে। আমার চিন্তা শুধু বিমান ভাড়াটা যোগাড় করে দেশে ফেরা। প্রায় হাজার খানেক ডলার ঋণ। বিমান ভাড়াসহ দুই হাজার ডলার প্রয়োজন। দুই মাস জানোয়ারের মতো কাজ করলে দুই হাজার ডলার জমানো যায়। কিন্তু এতো কায়িক পরিশ্রম কি সম্ভব? তার উপর ওমাওয়ারিসান এর ভয়। আফটার অল পুলিশতো।

মাঝে মধ্যে জাপানিরাও বলে বসে 'গাইজিন দামে দেছো' অর্থাৎ বিদেশি ভালো না।

এসব মনঃকষ্ট নিয়ে একটা ফোন কার্ড কিনে মেজো আপাকে ফোন করলাম। তখন সেল ফোন ছিলো না। টিএন্ডটি ফোনই একমাত্র সম্বল। হাউমাউ করে কেঁদে বললাম, আপা আমি জাপানে থাকবো না। এখানে পড়াশোনা করা সম্ভব না। হয়তো শিগগির চলে আসবো। আর এখানে হোটেলে প্লেট ধোয়ার কাজ করতে হয়। সারাদিন বেসিনে হাত ভিজিয়ে রাখতে হয়। আমার কি সুন্দর হাতগুলো বেসিনের ময়লা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে রাখতে দাগ পড়ে গেছে। আপা অবাক হয়ে বললেন, কস কি! আর খুশি খুশি মনে বললেন, তোর বড় ভাগ্নির বিয়ে হয়েছে। তোকে জানাতে পারিনি। আসার সময় ছোট মামা শ্বশুর হিসাবে ভাগ্নি জামাইর জন্য একটা দামি ঘড়ি নিয়ে আসিস। জ্বি আচ্ছা, বলে ফোন ছেড়ে দিলাম। মরার উপর খাড়ার ঘা। আরো কমপক্ষে তিনশ ডলার ঘড়ির জন্য।

এ রকম আকাশ পাতাল দুঃখ নিয়ে শিনজুকু এলাকায় স্কুলের কাছাকাছি একটা রেস্টুরেন্টে ওয়েটারের কাজ নিলাম। নয় দিন কাজ করার পর এক দুপুরে চার জন কাস্টমার এক সঙ্গে ঢুকলো। জাপানে ওয়েটারের প্রথম ও প্রধান কাজ হলো, কাস্টমার ঢুকলেই বলতে হবে 'ইরাশ্যাইমাছে দোজো' অর্থাৎ স্বাগতম- প্লিজ বসুন। এটা জাপানি কালচার। ওনারা বসলেন। অর্ডার করলেন। খাবার টেবিলে সাজিয়ে দিলাম খুব মায়া করে। খাওয়া শেষ করে বিল দিলেন। আমাকে টিপসও দিলেন।

এক ফুট মাথা নুইয়ে জাপানি ভদ্রতায় বললাম, দমো, আরিগাতো গুজাইমাছ। ধন্যবাদ, আবার আসবেন।

একজন ভদ্রলোক বিনীতভাবে আমাকে বললেন, 

ছুমিমাছেন অর্থাৎ মাফ করবেন, আমি কি আপনার জাপানে অবস্থানের বৈধ কাগজপত্র দেখতে পারি? আমরা জাপান ইমিগ্রেশন পুলিশ। হাত দিয়ে গলায় ঝুলানো আইডি কার্ড শার্টের ভেতর থেকে চার জন একসঙ্গে বের করলেন।

শিরদাঁড়া শিনশিন করে উঠলো। খাইছে আমারে! বন্ধুদের হাওলাতি টাকা, বিমান ভাড়া এবং নতুন যন্ত্রণা ভাগ্নি জামাইর জন্য ঘড়ি। পকেট থেকে বের করে Alien Registration Card সহ (টোকিও মিউনিসিপাল অফিস থেকে দেয়া ছবিসহ নাম ও জাপানের বাসার ঠিকানা এবং ভিসার মেয়াদ উল্লেখ থাকে এই কার্ডে)স্কুলের কার্ডটিও দিলাম। একজন পুলিশ বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, আনাতা ওয়া উছো গাকছেই দেসকা? অর্থাৎ তুমি কি একজন মিথ্যা ছাত্র?

আমি শ্রদ্ধেয় চার পুলিশকে তোতলা জাপানি আর ভালো ইংরেজিতে খিচুড়ি বানিয়ে বললাম, আমি আপনাদের দেশে পড়াশোনা করতেই এসেছিলাম কিন্তু ভাষাগত সমস্যায় তা পারছি না। নিহঙ্গ মুজোকাশি দেসো। জাপানি খুব কঠিন ভাষা। আমি নিয়ম কানুন জানতাম না। তাই দেশে চলে যাবো। কিন্তু আমার দেশে ফেরার বিমান ভাড়া নেই। তাই কাজ করছি । বিমান ভাড়াটা হলেই দেশে চলে যাবো ।

ওনারা পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলেন। সম্ভবত আমার কম বয়স দেখে বিশ্বাস করলেন। তবু একজন মধ্যবয়সী পুলিশ রুক্ষ ভাবে প্রশ্ন করলেন-হন্ত নি?  অর্থাৎ সত্য নাকি?

বললাম,হন্ত। সত্য।

জানতে চাইলেন বিমান ভাড়া যোগাড় করতে কতোদিন কাজ করতে হবে?

কোন হিসেব ছাড়াই বলে ফেললাম, তিন মাস।

রুক্ষ পুলিশটি এবার আমার কাঁধে হাত রেখে মায়া করে শাসনের ভঙ্গিতে বললেন, তিন মাস পর যদি তোমাকে টোকিওতে পড়াশোনা ফেলে কাজ করতে দেখি তবে পিছমোড়া বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেবো। মনে থাকে যেনো। ওয়াকারিমাস্তা? বুঝেছো?

মাথা নেড়ে আস্তে বললাম, ওয়াকারিমাসো। বুঝেছি।

দুইমাস একুশ দিন পর আমার বিমান ভাড়া, বন্ধুদের হাওলাতি টাকাসহ ভাগ্নি জামাইর জন্য দামি ঘড়ি কেনার টাকা হয়ে গেলো। তিন মাস পূর্তি হওয়ার কয়েকদিন আগেই আমি ইজিপ্ট এয়ারের এমএস ৬০৪ ফ্লাইটে ঢাকার উদ্দেশে ব্যাংককে তিন দিনের ট্রানজিট করে টোকিও ছাড়লাম।

বিকেল ঠিক পাঁচটায় বিমান টোকিওর নারিতা এয়ারপোর্ট থেকে টেক অফ করলো। আমি জানালা দিয়ে নিচে তাঁকিয়ে রইলাম। বিমান উপরে উঠছে আর আস্তে আস্তে টোকিও শহর দূরে চলে যাচ্ছে। এক সময় অদৃশ্য হয়ে গেলো।

ককপিট থেকে পাইলট ঘোষণা করলেন, বিমানটি এখন জাপান সাগর অতিক্রম করছে। ইজিপশিয়ান সুন্দরী এয়ার ক্রুরা খাবারের ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে আসতে লাগলো। আমি আত্মগতভাবে বললাম, দমো, সাইওনারা নিহনজিন ওমাওয়ারিসান। ধন্যবাদ। বিদায় জাপানি পুলিশ।

© Karim Chowdhury

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আমার দেখা ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ

আমার দেখা ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ সরকারঃ শেখ মুজিবের শাসনামল ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের মার্চে শুরু হয়ে সেই বছরেরই ডিসেম্বরের দিকে গিয়ে শেষ হয়। এই দুর্ভিক্ষে অসংখ্য মানুষ অনাহারে মারা গিয়েছিল। এই দুর্ভিক্ষকে স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক হিসেবে গন্য করা হয়। ওই সময় আমি বুঝতাম। ক্লাশ ফোরে পড়তাম। আহারে ! কি যে অভাব ! অনেকের মতো আমরাও ভাত না খেয়ে রুটি খেয়েছি । তাও পরিমিত । কখনো জাউ খেয়েছি । শুকনো মরিচ পাওয়া যেতো না । কাঁচা মরিচের কেজি ছিলো ১৫০ টাকা । লবন ১২০ টাকা । আর সোনার ভরি ছিলো তখন ১৫০ টাকা । সোনা শুধু ওই সময় কম দাম ছিলো । চারদিকে অভাব । সারাদেশের মানুষের হাহাকার । কতো মানুষ না খেয়ে মারা গেছেন ! বিদেশি রিলিফ সব আওয়ামী লীগের লোকেরা চুরি করেছে । আর বেশিরভাগ রিলিফ সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে পাচার হয়েছিলো । তখন বর্ডার খোলা ছিলো তখন । মহিলাদের শাড়ি কাপড় ছিলো না । অনেকে মাছ ধরার জাল পরে লজ্জাস্থান ঢেকেছিলো । এসব ছবি পত্রিকায়ও ছাপা হয়েছিলো । কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতাদের কোনো অভাব ছিলো না । বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র দুই বছর তিন মাসের মাথায় ...

বোতল

বোতল মানব জীবনে বোতল অপরিহার্য । বোতল অনেক অর্থেও ব্যবহার হয় । কোনো কোনো এলাকায় আনস্মার্ট, বেয়াক্কেল প্রকৃতির লোককেও বোতল বলা হয় । ইউরোপ আমেরিকায় থাকতে আমি ডৃংক করতাম । হার্ড ডৃংক কমই খেতাম । প্রতিদিনই বিয়ার খেতাম । বিয়ার স্বাস্থ্য ভালো রাখে ও কাজ করতে এনার্জি জোগায় । পরিমিত বিয়ার খেলে কেউ মাতাল হয় না । মাঝে মাঝে বিশেষ কোনো পার্টিতে হুইস্কি খাওয়া হতো । তাও দামি ব্র্যান্ডের । জনি ওয়াকার ব্ল্যাক লেবেল, টিচার্স, পাসপোর্ট, হেনেসি, শিভাস রিগাল, জ্যাক ড্যানিয়েলস । সাকুরায়ও অনেক সময় এসব ব্র্যান্ডের হুইস্কি পাওয়া যায় না । তো দেশে আসার পরও কিছু দিন ডৃংক করেছিলাম । কুমিল্লায় সরকার অনুমোদিত একটা মদের দোকান আছে চক বাজারে । নামঃ নাদের ট্রেডিং কোং । এটা প্রায় আজ ৫০ বছর । এখানে বিদেশি ব্র্যান্ডের ডৃংক পাওয়া যায় না । দেশিয় কোম্পানি ‘কেরো এন্ড কোং’ যা দর্শনায় অবস্থিত তার তৈরি ভদকা, হুইস্কি, জিন পাওয়া যায় । আমাদের সমাজতো রক্ষনশীল । তাই কান্দিরপাড় থেকে একটা স্প্রাইট কিনে অর্ধেক খেতে খেতে চক বাজার যেতাম । নাদেরে যখন পৌঁছতাম তখন স্প্রাইটের বোতল অর্ধেক খালি হয়ে যেতো । আমি বাবুল ভাইকে স্প্...

অশ্লীল নাম

বাংলাদেশের কিছু প্রতিষ্ঠান ও স্থানের বিচিত্র বা বিকৃত অর্থের নাম যা পরিবর্তন করা উচিতঃ ১. বোদা মহিলা মহাবিদ্যালয়, বোদা, পঞ্চগড় ২. চুমাচুমি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রাঙ্গামাটি ৩. সোনাপোতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, খুলনা ৪. মানুষমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নীলফামারি ৫. সোনাকাটা ইউনিয়ন, তালতলী, বরগুনা ৬.বড়বাল ইউনিয়ন, মিঠাপুকুর, রংপুর ৭.সোনাখাড়া ইউনিয়ন, রায়গঞ্জ, সিরাজগঞ্জ ৮. ধনকামড়া গ্রাম, ভোদামারা, দিনাজপুর ৯.গোয়াকাটা, দোহার, ঢাকা ১০. গোয়াতলা, ময়মনসিংহ ১১.লেংটার হাট, মতলব, চাঁদপুর