আমেরিকান ভিক্ষুক
----------------------------
ভিক্ষুকের সামনে একটা এলুমিনিয়ামের থালা। তার পাশেই লেখা...
"দয়া করে কয়েন ফেলে শব্দ দূষণ করবেন না। নোট প্রদান করুন।"
বিষয়টা অনেকের কাছে হাসির বা অবিশ্বাস্য মনে হলেও আমার কাছে সত্য। আমি বিদেশে খুব ঘোরাঘুরি করতাম। সুযোগ পেয়ে বাঁদরামিও কম করিনি। ভিক্ষুক নিয়ে সবারই কম বেশি অভিজ্ঞতা আছে।
আমেরিকার প্রায় সবকিছুই আমার ভালো লাগে একমাত্র তাদের সাম্রাজ্যবাদী ফরেন পলিসি ছাড়া। বাংলাদেশের কয়েকজন ভিক্ষুককে তাদের আচরণের কারণে এক সময় আমি মারতেও চেষ্টা করেছিলাম। বিবেকের বাধায় মারতে পারিনি। ওরা ভীষণ বিরক্ত করে। সময় অসময় বুঝে না। সকালে বাসায় এসে ডোর বেল বাজিয়েও ডাকে অথচ আমি ঘুমে!
এক আমেরিকান ভিক্ষুকের সঙ্গেও আমার ঝগড়া হয়েছিলো। সেই কবে রোববার গ্রীস্মের এক বিকেলে আমি নিউ ইয়র্কের ফিফথ্ এভিনিউ ধরে হাঁটছিলাম। অনেক নামি দামি লেখকরা তাদের লেখায় ফিফথ্ এভিনিউকে ( 5th Avenue ) পৃথিবীর বিখ্যাত রাস্তা বলে উল্লেখ করেছেন। ফিফথ্ এভিনিউর ফর্টি সেকেন্ড স্টৃটের কোণায় নিউ ইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরি। অনেক বড় লাইব্রেরি। বিশাল বড়। সামনে পেছনে বিরাট লন। বিকেলে বসে সময় কাটানো বেশ আনন্দময়।
সেই লাইব্রেরি থেকে স্বদেশ দা'কে ( স্বাদেশ রায় ওই সময় যায়যায়দিনের সহকারি সম্পাদক ছিলেন। তিনি এখন জনকণ্ঠে আছেন ।) একবার ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চের ওয়াশিংটন পোষ্ট পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠা পাঠিয়েছিলাম। যেখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সচিত্র খবর প্রকাশিত হয়েছিলো শিরোনাম হিসেবে। স্বাদেশ দা লেখলেখির প্রয়োজনে ২৯ মার্চ ১৯৭১ সালের ওয়াশিংটন পোষ্ট পত্রিকার প্রথম পাতার রিপোর্ট চেয়ে আমাকে অনুরোধ করেছিলেন। এই লাইব্রেরি নিয়ে আরেকদিন লিখবো যদি মনে থাকে। সেখানে একশো বছর আগের পত্রিকাও পাওয়া যায় মাইক্রো ফিল্মে।
আমার বেশিরভাগ লেখাই স্মৃতিকথা। এমনকি প্রেমের গল্পগুলোও। তাই আমি উত্তম পুরুষেই লিখি। কোনো রাখঢাক নেই।
আজ আমেরিকান ফকিরের কথা।
তো ফর্টি সেকেন্ড(42nd) স্টৃটের কোণায় একজন ভিক্ষুক একটা ফোল্ডিং চেয়ারে বসেছিলো। জোয়ান ভিক্ষুক। তার পরনে ব্লু রঙের জিন্স প্যান্ট। গায়ে সাদা রঙের টি শার্ট। টি শার্টের বুকে লাল রঙে লেখা I Love New York. মাথায় কাউবয় ক্যাপ। চোখে সানগ্লাস। পায়ে সাদা রঙের ক্যাডস। তার পাশে একটা ছোট প্লে কার্ড।
লেখা –
I am Homeless. Help Me. Thank You.
পাশে দিয়ে যে-ই যায় তাকেই সে বোল্ডলি বলে Give Me a Dollar Man. I Need a Beer. তাকে মাত্র এক ডলার দিতে সে একটা বিয়ার খাবে। আমি কাছে আসতেই সে জোরে বললো -Give Me a Dollar Man. I Need a Beer. যেনো সে আমার কাছে টাকা পায়! এমন ভাব। বাংলাদেশ হলে আমি তাকে মারতাম। আমেরিকা এমন দেশ ভিক্ষুক মারলেও জেলে যেতে হবে। আমিও কিছুটা জোরেই উত্তর দিলাম- I don't have man.
ওমা ! আমি একটু দূরে যেতেই সে পেছন থেকে চিৎকার করে বললো- You Liar Man. I know you have. আমি দাঁড়ালাম। মনে কষ্ট পেলাম। সে আমাকে সরাসরি বলছে - তুমি মিথ্যুক। আমি জানি তোমার কাছে টাকা আছে আর তুমি বলছো নাই ! আমি ভিক্ষুকের কাছে এসে তার নাম জানতে চাইলাম। সে বললো, পিটার। আমি বললাম,
তুমি আমাকে মিথ্যাবাদী বললে কেনো? সে তর্ক করে বললো- তোমার কাছে টাকা আছে আর তুমি বলছো নাই! সে জোর দিয়ে বললো Is it not a Lie? আমি বললাম, আছে কিন্তু তোমাকে দেবো না। সে আমাকে গালি দিয়ে বললো F*u*c*k You Man। রীতিমতো সে আমাকে গালাগালি শুরু করেছে ! আমি বললাম, তোমার কি চাই? সে এবার নরম সূরে, মুখে অনুরোধের ছাপ নিয়ে হাত নেড়ে বললো- Give Me One Beer Man. You know I need It. আমাকে একটা বিয়ার দাও। তুমি জানো আমার এটা দরকার। তার বিয়ার দরকার। আমি এটা জানি!?
আমার মন দ্রবীভূত হলো। মায়া লেগে গেলো। তাকে বললাম, Come On. Let’s drink together. এসো। দু'জন এক সঙ্গে বিয়ার খাবো।
সে উঠে চেয়ারটা ফোল্ড করে আমার সঙ্গে এলো।
পাশেই একটা বারে আমি আর ভিক্ষুক ঢুকলাম। তাকে বললাম, তুমি আজ যতো মদ খাবে সব বিল আমি দেবো। সে অনেক দুঃখের কথা বললো। তার বাড়ি অ্যারিজোনা স্টেটে। নিউইয়র্ক থেকে অ্যারিজোনা (Arizona) ২৩৩৫ মাইল। কিলোমিটার নয়। অনেক দূর। অ্যারিজোনার রাজধানী ফিনিক্স (Phoenix)। জীবনের প্রতি তার কোনো আগ্রহ নেই। আরো অনেক ব্যক্তিগত,পারিবারিক কথা।
অনেকেরই মনে থাকার কথা, ক্লিনটনের প্রেসিডেন্সির সময় একবার ৪০ জন যুবক ক্যালিফোর্নিয়ায় একসঙ্গে আত্মহত্যা করেছিলো। তাদের কোনো দাবি ছিলো না। আত্মহত্যার নোটে তারা লিখেছিলেন -
এ জীবন তাদের ভালো লাগে না। তাই তারা আত্মহত্যা করেছে।
এ নিয়ে বিল ক্লিনটন জাতির উদ্দেশ্যে টিভিতে ভাষণও দিয়েছিলেন যুবকদের উজ্জীবিত করে। বেঁচে থাকার প্রেরণা দিতে। জীবন সুন্দর তা বুঝাতে।
আমি ভাবলাম, ভিক্ষুক পিটারকেও বোধহয় এই রোগে পেয়েছে। রাত ১০টায় বিয়ার, হুইস্কি খাওয়া শেষে বিল দিয়ে বার থেকে বের হয়ে আমি তাকে আরো বিশ ডলার দিতে চাইলে সে নেয়নি। বললো, I don’t need man. It’s enough. I thank you.
আমাকে গুড নাইট বলে সে হুইটনি হিউস্টনের 'I will always love you' 'আমি চিরকালই তোমাকে ভালোবাসবো' গানটি গাইতে গাইতে চলে গেলো।
© Karim Chowdhury
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন