আমার খৎনা কাহিনী
ইসলামি সংস্কৃতিতে পুরুষদের মধ্যে খৎনা বা ত্বকচ্ছেদ প্রথা প্রচলিত যা আরবি ভাষায় খিত্না বা খিতান্ নামে প্রচলিত। পুরুষ খৎনা মুসলিম সমাজে ব্যাপক প্রচলিত এবং আইনত ইসলামের সকল মাযহাব কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত অনুশাসন হিসাবে গৃহীত হয়েছে। এটি বৃহত্তর ইসলামি সম্প্রদায়ের (উম্মাহ) অন্তর্ভুক্ত হওয়ার চিহ্ন হিসাবে বিবেচিত হয়।
গত কয়েকদিন সুন্নতে খৎনার সময় দুটো ছেলের প্রাণ গিয়েছে। একজনের নাম আয়ান। আরেকজনের নাম আয়হাম। খুবই দুঃখজনক ঘটনা। এই ঘটনা দুটো পত্রিকায় পড়ে আমার নিজের সুন্নতে খৎনার কথা মনে পড়ে গেল।
আমার খৎনা একটু দেরিতে হয়েছিলো। তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। একদিন স্কুল থেকে ফিরে খেতে বসেছি। সেজো ভাবী ভাত দিয়েছেন। আমি খাচ্ছি। এমন সময় ভাবী বললেন, 'কালকে তোমারে জবাই করবো'। আমি অবাক হয়ে ভাবীর কাছে জানতে চাইলাম ঘটনা কী। ভাবী জানালেন, কালকে তোমার মুসলমানি। আমাদের সময় গ্রামে খৎনাকে মুসলমানি বলা হতো।
আমি অর্ধেক ভাত রেখে উঠে গেলাম। ভাবী বললেন, কি ব্যাপার ভাত খাইলানা? আমি কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। আমার মনে এক বিরাট যন্ত্রনা শুরু হলো। বিরাট ভয়। ছুরি দিয়ে পোঁচ দিয়ে আমার শরীরের একটা অংশ কেটে ফেলবে। বিরাট ডড়াইছি।
সারা দুপুর পুকুর পাড়ে, গাছ তলায়, কখনো জাম গাছে ওঠে ডালে বসে সময় কাটালাম। কিন্তু আমার মনে শান্তি নাই। বিকালে সমবয়সী সব বন্ধুবান্ধব চাচাতো ভাইয়েরা খেলছে। আমি খেলায় যোগ দেই নাই। আমার মনে বিরাট অশান্তি। রাত পোহালেই আমার কোরবানি। মসজিদটা আমাদের বাড়ির লাগোয়া। এর চারদিকে ৫ ইঞ্চি ওয়াল করা কোমর পর্যন্ত। আমি সেই ৫ ইঞ্চি ওয়ালের উপর উঠে হেঁটে হেঁটে ঘুরতে লাগলাম আর মনের মধ্যে যন্ত্রণাকে প্রশমিত করার চেষ্টা করলাম। মনকে সান্ত্বনা দিলাম, থাক। খেলাধুলা করার সময় তো পড়ে গিয়ে পা ছিলে যায় বা হাত কেটে যায়। অনেক সময় অনেক রকম ব্যথা পাই। ইটের মধ্যে উষ্টা খেয়ে নক উল্টে যায়। এটা আর এমনকি? অল্প একটু পাতলা চামড়া এটা পোঁচ দিয়ে কেটে ফেলবে এই তো।
অনেক রকমভাবে নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম কিন্তু কিছুতেই আমার ভয় কাটে না। আমার মনে একটাই অশান্তি ছুরির পোঁচ দিয়ে আমার আমার শরীরের একটা অংশ কেটে নেবে। খাইছে আমারে।
এই রকম অশান্তির কথা ভাবতে ভাবতে ভাবলাম, আমাকে ভাগতে হবে। কোথায় যাবো? বড় আপার বাসা রেইস কোর্স। বাড়ি থেকে খুব কাছে। ওই সময় রিকশা ভাড়া ছিলো এক আনা। পাঁচ পয়সা আর এক পয়সায় ছয় পয়সা মিলে এক আনা। আমি মাগরিবের নামাজের সময় এক রিকশায় আপার বাসায় চলে গেলাম। বাড়ি থেকে বাসা খুব কাছাকাছি হওয়ার কারণে আমাদের বাড়ির সঙ্গে বোনদের ( আমার তিন বোন শহরে) সবারই যোগাযোগ ছিলো প্রতিদিন।
যাক, বাড়িতে জানতে পেরেছে যে আমি আপার বাসায় চলে গেছি। মা বুঝেছেন যে আমি ভয় পেয়ে ভাগছি। দুদিন পর বাড়িতে আসলাম। কেউ কিছু বলেন না। আনন্দে খাওয়া দাওয়া করে রাতে ঘুমালাম। পরদিন সকাল ছয়টা কি সাতটা বাজবে আমি ঘুমে থাকতেই আমার এক চাচাতো ভাই আমার সমবয়সী এবং আমরা একই ক্লাসে পড়তাম তবে ওর গায়ে মাশাল্লাহ প্রচুর শক্তি ছিলো। ও আমাকে ঘুমের মধ্যে জাপটে ধরেছে। মা যে আগেই এই ষড়যন্ত্র করে রেখেছেন তা তো জানতাম না।
আগেই বলেছি আমাদের সময় খৎনা বলা হতো না। বলা হতো মুসলমানি। যিনি মুসলমানি করান তাকে কুমিল্লার স্থানীয় ভাষায় বলা হতো 'আজাম'। আরো স্পষ্ট করে বললে তাকে বলা হতো 'আজাইম্যা'। তিনি এই কাজে মাত্র ১০/২০ টাকা নেন। ইতিমধ্যেই তিনি ছোট একটা ব্যাগ নিয়ে আমাদের বাড়িতে হাজির। চাচাতো ভাই শক্ত করে আমার হাত ধরে রাখলো। আমি মুখও ধুইনি। এরপর আমাকে একটা ছোট চৌকি আমরা বলি জলচকি। পিড়ির এক উঁচু। এটাতে বসানো হলো আমাকে। দুই হাত দুই রানের নিচে দিয়ে নিয়ে কাঁধের উপর দিয়ে ওই দুই হাতে ধরেছে। আরেকজন চোখে ধরেছে। নড়াচড়ার কোনো সুযোগ নাই। আমি চিৎকার করে বলি না না না।
আমরা যে এখন কাপড় রোদে দেওয়ার সময় ক্লিপ দেই এরকম বাঁশের তৈরি এবং মাঝখানে রাবার দিয়ে বাধা ক্লিপ নিয়ে আসতেন আজাম। ওই ক্লিপটা চামড়ার মধ্যে আটকে একটু টান দিয়ে উনার যে ধার ছোট ছুড়িটা আছে সেটা দিয়ে এক পোঁচে কেটে ফেললো। আগেই সাদা গেঞ্জির নরম কাপড় পুড়ে ছাই করে রাখা আছে। কাটার পর সেই ছাই কাটা জায়গার উপর দিয়ে চতুর্দিক দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেয়। কাজ শেষ। আমি তখনো চিল্লাই..না না না। কিন্তু কাজ অলরেডি শেষ।
এরপর শুয়ে বসে থাকা। হাফপ্যান্ট না পরে ছোট লুঙ্গি পরা। বেশি হাঁটাচলা না করা। কোনো ওষুধ বড়ি নেই। আমাদের সময় উঠানের মধ্যে একটু গর্ত করে ওটার মধ্যে বরই গাছ থেকে ডাল কেটে ওই গর্তের মধ্যে দিয়ে ওটাতে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হতো। তার পাশে মোড়া নিয়ে বসে ওই আগুনের ছ্যাক দেওয়া হতো। এভাবে আট দশ দিন পরই ঠিক হয়ে যায়। মাঝে মাঝে একটু জ্বলতো আর আমি বলতাম, পোড়ায় গো পোড়ায়। মানে জ্বলে। সেজো ভাবী পরে আমাকে এই নিয়ে অনেক ইয়ার্কি করতেন। আমাকে চেতাইতে প্রায়ই বলতেন, পোড়ায় গো পোড়ায়।
ওই রেস্টের সময় আমার বড় ভাগ্নী বয়সে আমার এক বছরের বড় পলি আমাকে একটা বই দিয়েছিলো। পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের 'বাঙালির হাসির গল্প'। এই মুসলমানির সময় অবসর জীবনে আমি এই বাঙালির হাসির গল্প বইটা পড়ে শেষ করেছি এবং হাসাহাসি করেছি অনেক। খুব মজার একটা বই।
এই হলো আমার খৎনার ইতিহাস।
এখন আমার প্রশ্ন, এই সামান্য কাজের জন্য এখন পিতা-মাতারা তাদের ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে ইউনাইটেড হাসপাতাল, স্কয়ার হাসপাতালে যায়। এনেস্থিসিয়া করে। বাচ্চা যাতে কষ্ট না পায়। কতো আদর! আমাদের বাবা মা আমাদের আদর করতেন না? বাচ্চা তো ভয়ে এমনি টেনশনে আছে। টাকার গরম দেখাতে আর কোনো জায়গা পায় না এরা। এটা একটা খুবই সাধারণ বিষয়। তিন চার পাঁচ বছরের বাচ্চারা বাসায় খেলতে খেলতে ঘুষি মেরে শোকেসের গ্লাস ভেঙ্গে তো হাতও কেটে ফেলে। খেলতে গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়ে দাঁতও ভেঙে যায়। ঠোঁট কেটে যায়। আরো অনেক আঘাত বাচ্চারা পায়। খৎনার চেয়ে বেশি জায়গা কেটেও ফেলে খেলতে খেলতে। আর এই সামান্য খৎনা তথা মুসলমানির জন্য এত বড় বড় হাসপাতালে নিয়ে ডাক্তারদের হাজার হাজার টাকা ভিজিট দিয়ে বাচ্চাকে অজ্ঞান করে নুনুর চামড়া কাটতে হবে? এর জন্য তো অভিভাবক দায়ী।
এখন আবার নতুন ট্রেন্ড। অনেকে গরু জবাই করে অনেক মানুষ দাওয়াত দেয়। উনার পোলার নুনু কাটছে এটা এতো মানুষকে জানানোর দরকার কী? দাওয়াত কিন্তু মাগনা না। চেয়ার টেবিল খাতা কলম নিয়ে একজন বসে থাকে টাকা নেয়ার জন্য। আগে টাকা দিয়ে খেতে হবে। এই দাওয়াত পুরোপুরিভাবে ব্যবসা। একজন মানুষ কয় টাকার খাবার খায়? ২/৩ শ টাকা সর্বোচ্চ। কিন্তু ৫০০ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত উপহার দেয়!
Karim Chowdhury
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন