সালাফিপন্থীদের কাবা দখল
----------------------------------------
এইতো সেদিন মাত্র ৪৫ বছর আগে আমরা তখন নাইন টেনে পড়ি। ১৯৭৯ সালে কাবা শরীফ দখল করেছিলো সালাফিপন্থী একদল উগ্র তথাকথিত মুসলিম। এই সালাফিপন্থীরাই আজকের আহলে হাদিস। এরা কিছু নির্দিষ্ট এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতেছে এ দেশে। এরা মূলত ওয়াহাবী মতাদর্শের অনুসারী। ২০-২৫-৩০-৩৫ বছরের পোলাপান এগুলো না বুঝে এই নিয়ে লাফালাফি করছে। এটা বেদাত ওটা বেদাত। মানে তাদের কাছে আমাদের ইসলাম শিখতে হবে। কিছু ভুয়া হাদিস আর না বুঝে কোরান পড়া ছাড়া এরা অন্য কোনো বইপুস্তক পড়েনি। আলজাজিরা, টিআরটি, সিএনএনসহ কোনো টিভি এরা দেখেনা। পত্রপত্রিকা পড়ে না। ইসলামের ইতিহাস এরা কিছুই জানে না। এরা নামাজকে বলে সালাত, ধন্যবাদকে বলে জাজাকাল্লাহ খাইরান। কবে জানি রাষ্ট্রভাষা আরবি দাবি করে বসে ঠিক নেই।
জুনিয়র আহলে হাদিস সদস্যদের জন্য এই পোস্ট। সিনিয়র অনেকেই জানেন।
১৯৭৯ সালের নভেম্বর মাসে পবিত্র মক্কা নগরীতে কট্টরপন্থী সালাফিরা কাবা ও হারাম শরীফ দখল করে নেয়। ইসলামের পবিত্রতম স্থান কাবা এবং একে ঘিরে তৈরি মসজিদ আল হারাম বা হারাম শরিফ দখল করেছিলো সালাফিপন্থী গোষ্ঠী। সালাফিরাই আজকের আহলে হাদিস। তাদের দখল থেকে মক্কাকে মুক্ত করতে যে তীব্র লড়াই চলে, তাতে নিহত হয় শত শত মানুষ। জামাতে নামাজ পড়া বন্ধ থাকে দুই সপ্তাহ।
১৯৭৯ সালের ২০শে নভেম্বর। ইসলামী বর্ষপঞ্জীতে এই দিনটির একটা প্রতীকী তাৎপর্য রয়েছে।
একটা নতুন শতাব্দীর শুরু সেদিন, হিজরী ১৪০০ সালের প্রথম দিন। পবিত্র মক্কা নগরীর মসজিদ আল হারাম, বা হারাম শরিফ সেদিন হাজার হাজার মানুষে পরিপূর্ণ।
সারা পৃথিবীত থেকে আসা মুসলিমরা সেদিনের ফজরের নামাজে যোগ দেয়ার অপেক্ষায়। মসজিদটি তৈরি করা হয়েছে চতুস্কোণ কাবা-কে ঘিরে। এটি হচ্ছে ইসলামের পবিত্রতম স্থান।
ফজরের নামাজ মাত্র শেষ হতে চলেছে। হঠাৎ সাদা কাপড় পরা প্রায় শ'দুয়েক লোকজন অস্ত্র হাতে বেরিয়ে এলো নামাজীদের মধ্য থেকে। এই অস্ত্র তারা আগেই সেখানে পাচার করে নিয়ে এসেছিলো।
কয়েকজন অস্ত্রধারী অবস্থান নিলো ইমামের চারপাশে। ইমাম যখন তার নামাজ শেষ করলেন, অস্ত্রধারীরা মাইক্রোফোনের নিয়ন্ত্রণ নিলো। তারপর তারা মাইকে এমন এক ঘোষণা দিলো, যা শুনে হতবাক হয়ে গেল সবাই।
অস্ত্রধারীদের একজন মাইকে বলছিলো, "আমরা আজ ইমাম মাহদীর আবির্ভাব ঘোষণা করছি। তিনি বিশ্বে ন্যায় বিচার এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা করবেন। যে বিশ্ব এখন অন্যায়-অত্যাচার এবং অশান্তিতে ভরে গেছে।"
দুই সপ্তাহ ধরে জঙ্গিরা দখল করে রেখেছিলো মক্কা।
ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী, ইমাম মাহদী বিশ্বে আবির্ভূত হবেন ইসলামকে পুনরুদ্ধার করতে। কেয়ামতের আগে দাজ্জালের শাসনকে উৎখাত করে ইমাম মাহদী বিশ্বে ইসলামকে পুন:প্রতিষ্ঠা করবেন। কেয়ামতের পূর্বে বিশ্ব ধ্বংস হওয়ার আগে ঘটবে এই ঘটনা।
যে সশস্ত্র গ্রুপটি সেদিন কাবা এবং হারাম শরিফের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল, তারা ছিলো সালাফিপন্থী একটি কট্টর সুন্নী গোষ্ঠী। তাদের নেতা ছিলেন এক বেদুইন, জোহাইমান আল ওতাইবি।
মসজিদের মাইকে জোহাইমান আল ওতাইবি ঘোষণা দিলেন, ইমাম মাহদি সেখানে তাদের মাঝেই আছেন।
তার এই ঘোষণার পর সশস্ত্র গ্রুপটির মধ্য থেকে একজন সামনে এগিয়ে এলেন। তিনি জোহাইমানের সম্পর্কিত ভাই। তাঁর নাম মোহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ আল কাহতানি। জোহাইমান দাবি করলেন, এই মোহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ আল কাহতানিই হচ্ছেন ইমাম মাহদী। যিনি আসবেন বলে ইসলামে আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে।
তারপর জোহাইমান সামনে এগিয়ে আসলো এবং ইমাম মাহদীর প্রতি তাঁর আনুগত্য ঘোষণা করলো। সে লোকজনকে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হলো যে, ইনিই হচ্ছেন মাহদী। তখন সবাই মাহদীর সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের আনুগত্য প্রকাশ করতে শুরু করলো।
বিদ্রোহীদের নেতা জোহাইমান পবিত্র কাবাকে ঘিরে একটি অবরোধ তৈরির নির্দেশ দিলেন। মসজিদের মিনারগুলিতে জোহাইমান বন্দুকধারীদের অবস্থান নেয়ার নির্দেশ দিলেন, যাতে কেউ হামলা করলে তাদের প্রতিরোধ করা যায়।
সৌদি পুলিশ বাহিনীর একটি দল প্রথম এগিয়ে এলো কী ঘটছে দেখতে। সৌদি পুলিশকে দেখা মাত্র তারা গুলি চালাতে শুরু করলো। অনেকেই নিহত হলো। শুরু হলো কাবা এবং হারাম শরিফকে ঘিরে অবরোধ।
ঘটনার পরই সৌদি সরকার এই খবর প্রচারের উপর পূর্ণাঙ্গ নিষেধাজ্ঞা জারি করে। খুব কম লোকই জানতো কারা কী কারণে মসজিদ দখল করেছে।
যে বন্দুকধারীরা গুলি করছিল, তাদের হাতে খুবই ভালো অস্ত্র ছিল। বেশ ভালো ক্যালিবারের বন্দুক। তারা বেশ কিছু লোককে গুলি করে মেরে ফেলতে সক্ষম হয়।
বন্দুকধারীদের মোকাবেলায় প্রথম চেষ্টাটা ছিল খুবই কাঁচা। অল্প সংখ্যাক ন্যাশনাল গার্ড এবং সামরিক বাহিনীর সদস্য প্রথম সেখানে গিয়েছিল। তারা বেশ সাহসী প্রচেষ্টা চালায়, কিন্তু তাদের সাথে সাথেই গুলি করে মেরে ফেলা হয়।
এদিকে সৌদি প্রিন্স ফাহাদ তখন একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিতে তিউনিসিয়াতে ছিলেন। আর ন্যাশনাল গার্ডের প্রধান প্রিন্স আব্দুল্লাহ ছিলেন মরক্কোতে। অসুস্থ সৌদি বাদশাহ খালিদ এই মিশনের দায়িত্ব দেন প্রিন্স সুলতানের উপর। যিনি ছিলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্বে। সঙ্গে ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স নায়েফ।
সৌদি সরকার এরপর সেখানে হাজার হাজার সৈন্য এবং কমান্ডো পাঠায় মসজিদ পুনর্দখলের জন্য। পাঠানো হয় সাঁজোয়া যান। মক্কার আকাশে উড়তে থাকে যুদ্ধ বিমান।
কাবা এবং হারাম শরিফের ভেতরে সামরিক অভিযান চালানোর জন্য সৌদি রাজপরিবার দেশটির ধর্মীয় নেতাদের কাছে অনুমতি চাইলেন। পরবর্তী কয়েকদিনে সেখানে তীব্র লড়াই শুরু হলো। সৌদি সরকারি বাহিনী একের পর এক হামলা চালাতে লাগলো। মসজিদের একটি অংশ বেশ ক্ষতিগ্রস্থ হলো।
হারাম শরিফের মিনার লক্ষ্য করে গোলাও ছোঁড়া হয়েছিলো। মক্কার আকাশে সার্বক্ষণিকভাবে হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছিলো।
মোহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ আল কাহতানি এই লড়াইয়ের পুরোভাগে ছিলেন। নিজের চোখে তা দেখেছেন আবদুল মোনায়েম সুলতান।
মক্কাকে ঘিরে এই অবরোধের অবসানের জন্য সৌদিরা তখন ফরাসী সামরিক অধিনায়কদের সঙ্গে শলাপরামর্শ শুরু করলো। ফরাসী বিশেষ বাহিনীর অধিনায়কদের গোপনে সৌদি আরবে আনা হলো।
এদিকে কিছুতে কিছু করতে না পেরে, সৌদি সরকার সিদ্ধান্ত নিলো যে, সন্ত্রাসীদের ভাতে মারবে। কিন্তু বোঝা গেলো,তারা প্রচুর খেজুর নিয়ে ঢুকেছে, আর জমজম কূপ থাকায় পানিরও সমস্যা নেই তাদের।
এই হামলা প্রতিহত করতে সৌদি সরকার গোপনে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত ফ্রান্সের কমান্ডোকে মক্কায় আনে। কিন্তু যেহেতু নিয়ম অনুযায়ী কোনো অমুসলিম মক্কায় প্রবেশ করতে পারে না। তাই তারা সাময়িকভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। তবে তারা কম্পাউন্ডের ভেতরে প্রবেশ করেনি।
পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ তার আত্নজীবনী 'ইন দ্য লাইন অফ ফায়ার' বইতে লিখেছেন, নিজেদের অপারগতায় সৌদি সরকার তখন পাকিস্তানি আর্মির স্পেশাল ফোর্সের সাহায্য চায়। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফ তখন ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল। তার নেতৃত্বে কমান্ডো অভিযান পরিচালিত হয়। তারা সমগ্র কাবা এলাকা হাঁটু পর্যন্ত পানিতে পূর্ণ করে তাতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয় ফলে বেশিরভাগ লোক মারা যায়।
ফরাসিরা পরামর্শ এবং অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছিল। এরা মসজিদের ভুগর্ভে যেখানে জঙ্গীরা লুকিয়ে আছে, সেখানে বিপুল পরিমাণ সিএস গ্যাস ছাড়ার পরামর্শ দিলো।
"সেখানে বাতাসে তীব্র কটু গন্ধ পাচ্ছিলাম আমরা, সেখানে থাকাটা খুবই কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। হয়তো পোড়া টায়ারের গন্ধ, কিংবা যারা মারা গেছে, তাদের দেহের পচা গন্ধ ভাসছিল সেখানে। সেই সঙ্গে সেখানে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমরা বুঝতে পারছিলাম, আমরা মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছেছি। গ্যাসে আমাদের শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছিল। আমি জানিনা, কিভাবে আমি সেখান থেকে বেঁচে গেলাম।"
শেষ পর্যন্ত যে জঙ্গীরা বেঁচে ছিল, তারা আত্মসমর্পণ করলো। এই অবরোধ চলেছিল দুই সপ্তাহ ধরে।
পরে জঙ্গীদের নেতা জোহাইমানসহ ৬৩ জনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। অন্যদের জেল হয়।
সৌদি কর্তৃপক্ষ নিহত তথাকথিত ইমাম মাহদী লাশের একটি ছবি প্রকাশ করে। শত শত মানুষ ঐ যুদ্ধে নিহত হয়েছিল। আহত হয়েছিল প্রায় এক হাজার। হারাম শরিফের বড় একটি অংশই এতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তবে পবিত্রতম অংশ, কাবা অক্ষত ছিল।
এই ঘটনার পর সৌদি রাজপরিবার সব ধরণের সংস্কার বন্ধ করে দেয়। জিহাদে উৎসাহ যোগাতে শুরু করে।
মক্কার ওপর এই দুঃসাহসিক হামলা পরবর্তী বছরগুলোতে ওয়াহাবী জঙ্গীদের নতুন প্রজন্মকে আরও অনেক নতুন হামলায় অনুপ্রাণিত করেছিল।
© Karim Chowdhury
28 February, 2024
Cumilla
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন